গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে মারাত্মক সংকটে নিমজ্জমান তার সংক্ষিপ্ত তালিকা দেখুন: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিপজ্জনক পতনের ধারা, টাকার হিসাবে ডলারের অব্যাহত দামবৃদ্ধি, প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্স প্রেরণে গেড়ে বসা হুন্ডি ব্যবসার ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে পতনের ধারা, মারাত্মক ডলার সংকটের কারণে আমদানি এল/সি খুলতে অপারগতা, কার্ব মার্কেটে হু হু করে ডলারের দাম বেড়ে ২০২১ সালের ৮৭ টাকা থেকে ২০২৪ সালের মার্চে ১১০–১৫ টাকায় উল্লম্ফন, বাংলাদেশী টাকার বৈদেশিক মানের প্রায় ২৮ শতাংশ অবচয়ন, আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং ও রফতানিতে আন্ডারইনভয়েসিং পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ব্যাপক পুঁজিপাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণ পাচার, খেলাপি ব্যাংকঋণ সমস্যার বিপজ্জনক অবনতি, রফতানি আয় দেশে ফেরত না এনে সেগুলো দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি–ব্যবসাপাতি ক্রয়, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বেলাগাম মূল্যস্ফীতির প্রকোপ, দুর্নীতি ও পুঁজি লুন্ঠন সম্পর্কে সরকারের অব্যাহত নিষ্ক্রিয়তা, দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট একাউন্টে গত চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মারাত্মক ঘাটতি পরিস্থিতি, ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ফাইনেন্সিয়াল একাউন্টে বহুদিন পর সৃষ্ট বিপজ্জনক ঘাটতি পরিস্থিতি, ২০২২–২৩ অর্থ–বছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ২০২৩ সালে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ। আরেকটু বিস্তৃতভাবে কয়েকটি সংকটের বর্তমান ভয়াবহতা দেখুন:
১) আইএমএফ এর নিয়ম অনুযায়ী ২০২৪ সালের মার্চে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ‘গ্রস রিজার্ভ’ ২০.৫৭ বিলিয়ন ডলার এবং নিট রিজার্ভ ১৭.২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতনের যে ধারা আমাদের অর্থনীতিকে চরম টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে তা সামাল দিতে পারছে না সরকার।
২) ২০২১ সালের আগস্টে দেশে এক ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা। গত দু’বছরে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে ২০২৪ সালের মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত বাজারে এক ডলারের দাম দাঁড়িয়েছে ১১০ টাকায়। এর মানে, এই দুই বছরে টাকার বৈদেশিক মান কমপক্ষে ২৮ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে।
৩) কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গত দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামাতে চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি, কারণ হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হওয়ায় ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স গত ২০২০–২১ অর্থ–বছরের ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২–২৩ অর্থ–বছরে ২১.৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যার প্রধান কারণ হুন্ডি প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স প্রেরণ আবার চাঙা হওয়া।
৪) কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে আমদানিকারকরা এলসি খুলতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক আমদানিকারক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ১১৭–১১৮ টাকায় ডলার কিনে এলসি খুলছেন বলে পত্র–পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।
৫) আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রফতানির আন্ডারইনভয়েসিং, রফতানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং হুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার—এই চারটি প্রধান অর্থ–পাচার প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ১৫–১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় এসব পুঁজিপাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা, প্রকৌশলী, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক, বিত্তবান ব্যবসায়ী কিংবা মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজের উচ্চ–মধ্যবিত্ত, উচ্চ–বিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাদের অবস্থান। তারা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছে। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ–লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছে। তারা রাজনীতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী। তারা ৫৩ বছরের স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজিলুন্ঠনের মাধ্যমে অর্থ–বিত্তের মালিক হয়ে তাদের অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে কানাডার টরোন্টোর ‘বেগম পাড়া’, অস্ট্রেলিয়ার সিডনীর ফ্রেটারনিটি এবং মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে।
৬) আমাদের মূল্যস্ফীতির হার সরকারের দাবি মোতাবেকই এখনো ৯.৬ শতাংশে রয়ে গেছে! সাধারণ ক্রেতাদের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেবে যে প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতির হার আরো অনেক বেশি।
উপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলো সমাধানের অযোগ্য কোন বিষয় নয়, কিন্তু সাবেক অর্থমন্ত্রীর অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে অনেকগুলো সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী সংকটে পরিণত হয়েছে। নূতন অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে আশা করি দেশ ক্রমেই এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠবে। তবে, প্রথমেই প্রয়োজন হবে সরকারী নীতির দিক্ পরিবর্তন। বিগত দিনগুলোতে সরকার খেলাপি ব্যাংকঋণ, পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স প্রেরণ, দুর্নীতি দমন এবং স্বল্প–প্রয়োজনীয় মেগা–প্রকল্প গ্রহণের হিড়িকের ব্যাপারে যে ভুল অবস্থান গ্রহণ করে চলেছিল সেখান থেকে অবিলম্বে সরে আসতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলছি, ব্যাংকের প্রায় আঠার লক্ষ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ইতোমধ্যেই সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকারও বেশি খেলাপিঋণে পরিণত হলেও রাঘব বোয়াল ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের’ বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে নানারকম অযৌক্তিক ছাড় দিয়ে খেলাপিঋণ লুকিয়ে ফেলার সুবন্দোবস্ত করে চলেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী, যার ফলে দেশের সুপরিচিত বড় বড় ঋণখেলাপি প্রায় সবাই এখন ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নিজেদের নাম লুকিয়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছে। অথচ, গত পাঁচ বছরে খেলাপিঋণ পুনরুদ্ধারে বিন্দুমাত্র কোন সফলতা অর্জিত হয়নি। দ্বিতীয় যে নজিরটি উল্লেখ করা যায় সেটি হলো, সাত শতাংশ কর দিয়ে পাচারকৃত পুঁজি দেশে ফেরত নিয়ে আসার যে ব্যবস্থা সাবেক অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় ঘোষণা করেছিলেন তার মাধ্যমে পরবর্তী অর্থ–বছরে একটি কানাকড়িও দেশে ফেরত আসেনি।
২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল নির্ধারিত ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটেগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ঐ প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তির পর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্ব ব্যাংকের ‘নিম্ন আয়ের দেশ’ ক্যাটেগরি থেকে বাংলাদেশ ‘নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশ’ ক্যাটেগরিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। গত দু’দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮–১৯ অর্থ–বছরে ৮.১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনা ভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯–২০ অর্থ–বছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩.৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থ–বছরের ১৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন তারিখে ২৭৬৫ ডলারে পৌঁছেছে বলে সরকার দাবি করছে। এহেন সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অর্থনীতি যে স্বস্তিকর অবস্থানে থাকার কথা তার পরিবর্তে এখন একঝাঁক সমস্যা অর্থনীতিকে টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে, যেটা সত্যিই দুঃখজনক।
আরেকটি দুঃখজনক ব্যাপারে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা অগ্রহণযোগ্য। মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে যদি দেশে আয়বন্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন–মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য যিনি সহগ সবচেয়ে বহুল–ব্যবহৃত পরিমাপক। কোন অর্থনীতির জিনি সহগ যখন বেড়ে ০.৫ এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা ০.৫ অতিক্রম করে তখন ঐ দেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ অভিহিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জিনি সহগ ছিল মাত্র ০.৩২, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক সেটা বেড়ে ০.৪৯৯ এ পৌঁছে গেছে। ধনাঢ্য ও উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠিগুলোর দখলে জিডিপি’র ক্রমবর্ধমান অংশ পুঞ্জীভবনের ফল কী হতে পারে তা নাটকীয়ভাবে ধরা পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র–ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এঙ’ এর প্রতিবেদনে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতি–ধনীর সংখ্যা–বৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ বিশ্ব–চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে। ঐ পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদের মালিক অতি–ধনীর সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে। দেশের আয় এবং সম্পদের এহেন পুঞ্জীভবন বাংলাদেশের রাজনীতিকে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ নিকৃষ্ট নজির হিসেবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূল নীতির মধ্যে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র পুনঃস্থাপিত হয়েছে। ২০১১ সালে সংসদে পাশ হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন মহাজোট সে রায়কে সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এখনো ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ অহিফেনের মৌতাতে মেতে রয়েছে। ২০০১–২০০৫—ঐ পাঁচ বছরে পাঁচবার বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব–চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করেছিল, এবার বিশ্ব–চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করলো ধনকুবেরের সংখ্যাবৃদ্ধির দৌঁড়ে। এসব ‘রবার ব্যারন’ সৃষ্টির জন্যে কি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম আমরা? একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আয়বৈষম্য এভাবে বাড়তেই পারে না, যদি শাসকরা সমাজতন্ত্রকে ‘বাত্ কা বাত’্ বানিয়ে না ফেলে! এসব ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছেই দেশের খেলাপি ব্যাংকঋণের ৮০ শতাংশেরও বেশি আটকে রয়েছে, এবং খেলাপিঋণের সিংহভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র–ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইনেন্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির হিসাব মোতাবেক এক দশক ধরে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার হয়ে চলেছে গড়ে ৭–৯ বিলিয়ন ডলার, এখন সরকারের অঙ্গ–প্রতিষ্ঠান সিআইডি বলছে শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়াতেই প্রতি বছর পুঁজিপাচার হচ্ছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫/১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে, যার বেশিরভাগ ব্যাংকের ঋণ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের দুর্নীতির র্যাংকিং অনুযায়ী বাংলাদেশ আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের র্যাংকিং অনুসারে ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান খারাপের দিক্ থেকে ১০ নম্বরে। এখনো এদেশের জনগণের জীবনের সবচেয়ে বেশি দুর্দশা, যাতনা ও হয়রানি ঘটিয়ে চলেছে সর্বব্যাপ্ত দুর্নীতি। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল, কিন্তু গত পাঁচ বছরে সরকার এই অঙ্গীকার পূরণকে ‘বাত্ কা বাতে’ পর্যবসিত করেছে। হুন্ডি ডলারের চাহিদার দিক্ বিবেচনা করলে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজিপাচারের সাথে দুর্নীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে কঠোর না হলে পুঁজিপাচার দমন করা অসম্ভব। পুঁজিপাচার দমন না করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামানো যাবে না।
সবশেষে উল্লিখিত বিষয়টি রাজনৈতিক হলেও অর্থনীতির জন্য সেটা মহাগুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরেকটি একতরফা নির্বাচন হয়ে গেলো। বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলকে সরকারে রেখে এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। এবারের নির্বাচনটা আবারো ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে হওয়ায় বিএনপিসহ দেশের প্রধান বিরোধীদলগুলো নির্বাচন বয়কট করেছে। নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৪টি আসনে জয়ী হয়েছে। কিন্তু, ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী যাঁরা জয়ী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ৬ জন ছাড়া ৫৬ জন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী হওয়ায় ২৮০টি আসনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়েছে বলা চলে। (জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং কল্যাণ পার্টির বিজয়ী প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগ–সমর্থিত)। নির্বাচনের দিন বিকেল তিনটায় নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছিল তখন পর্যন্ত ২৭.১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে, যেটাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। ভোটের পর এখন তারা বলছে, নির্বাচনে ৪১.৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। শেষের এক ঘন্টায় ১৪.৮৪ শতাংশ বৈধ ভোট পড়ার বিষয়টি একেবারেই অবিশ্বাস্য! ৭ জানুয়ারির নির্বাচনটি নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও এর সাংবিধানিক বৈধতা থাকবে। কিন্তু, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না। এ–ব্যাপারে শেখ হাসিনার কি কিছুই করণীয় নেই?
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়