৬ রমজান মহান হযরত সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল হাসানী ওয়াল হোসাইনীর ওফাত বার্ষিকী। মাত্র ৪০ বছর বয়সে ১৯০০ সালে ভারতে পশ্চিমবঙ্গের বান্ডেলে ইন্তেকাল করলে তথায় তাঁকে শায়িত করা হয়। তাঁরই অন্যতম খলিফা আজমগড়ী হযরতের মাধ্যমে তাঁর তথা হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুরের সিলসিলা বিশ্বের পাশাপাশি চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাপক বিকশিত হয়।
আজমগড়ী হযরতের সরাসরি মেয়ের ঘরের নাতি ডা. আবদুল বারী। তাঁর নানার আদর্শ মতাদর্শ নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করেন। উত্তর প্রদেশের আজমগড় জেলার বাসিন্দা হযরত শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.)। আজমগড় জেলার বাসিন্দা বিধায় এ অঞ্চলে আজমগড়ী হযরত হিসেবে সমধিক পরিচিত।
১৯০০ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৯ বছর তিনি বিশাল ভারতবর্ষের পাশাপাশি চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাপক সফর করেন তাবলীগে তরিকতের উদ্দেশ্যে। ফুরফুরা হযরত সুফি গোলাম সালমানী আব্বাসী (রহ.) নির্দেশ দিয়েছিলেন বছরে ন্যূনতম ৩ মাস তরিকতের সফর করতে। এতে তিনি সারা জীবন শারীরিক সক্ষম থাকা পর্যন্ত তা কার্যকর করে গেছেন। তৎমধ্যে ঢাকা অঞ্চলের পাশাপাশি চট্টগ্রাম অঞ্চল অন্যতম। তখন যাতায়াতে ছিল চরম প্রতিকূলতা। নদীপথে হলে নৌকা, সাম্পান, স্থলপথে হলে পায়ে হাঁটা। হয়ত গরুর গাড়ি, তান্জান বা পালকি। শতে এক পরিবারেরও কাছারী ঘর ছিল কি না তা বলা মুশকিল। এত সব প্রতিকূলতার মধ্যেও শুধুমাত্র তরিকতের খাতিরে, ধর্মের খাতিরে, দুনিয়ার আরাম আয়েশকে পদদলিত করে তরিকতের খেদমত করে গেছেন। ফলে বৃহত্তর ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চল বাদ দিলেও শুধুমাত্র চট্টগ্রাম অঞ্চল তথা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলায় হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুরের প্রর্বতিত আজমগড়ী হযরতের মাধ্যমে আজও লাখ লাখ মুরিদ শরীয়তের পাশাপাশি তরিকতের কাজ করে যাচ্ছেন।
আজমগড়ী হযরত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, উপমহাদেশ বিভাগ এসব কারণে ১৯৩৯ সালের পর থেকে এই অঞ্চলে সফরে আসেননি। অতি বৃদ্ধ বয়সে তরিকতের প্রয়োজনে ১৯৫৫ সালে ঢাকা হয়ে সপ্তাহ খানেকের প্রোগ্রামে চট্টগ্রাম সফর করেন।
দীর্ঘ ৩৯ বছর আজমগড়ী হযরত চট্টগ্রাম সফরকে গুরুত্ব দিয়েছেন বিধায় তাঁর রেখে যাওয়া ৪৪ জন খলিফার মধ্যে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম অঞ্চলে রয়েছেন ১৬ জন। তৎমধ্যে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলা, হযরত ছোট হুজুর কেবলা, আরাকানী হযরত (আরাকানে শায়িত হলেও এ অঞ্চলে তাঁর খেদমত), হালিশহরের হাফেজ ছাহেব হুজুর, চুনতী মাওলানা ফজলুল হক, মাওলানা নজির আহমদ, হাকীম মুনীর আহমদ অন্যতম। চুনতী হযরত শাহ ছাহেব কেবলা, কুতুবদিয়ার হযরত আবদুল মালেক ছাহেব এই আজমগড়ী সিলসিলারই অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বোয়ালখালীর হযরত আবদুল জব্বার (রহ.), বাঁশখালী ছনুয়ার মাওলানা খলিলুর রহমান, সাতকানিয়া করিয়ানগর মাওলানা ফজলুল রহমান ও মাওলানা ইকামুদ্দীন, কুতুবদিয়ার মাওলানা জামাল উদ্দিন, লোহাগাড়া পুটিবিলার মাওলানা অজিহুল্লাহ, সাতকানিয়া সদর মাওলানা আবদুল মাবুদ ও দোহাজারীর মাওলানা আবদুল হাকিম (রহ.) এর মাধ্যমে এ সিলসিলার ব্যাপক খেদমত হয়।
আজমগড়ী হযরত পরবর্তী তাঁর এই মহান ১৬ জন খলিফার মাধ্যমে এতদঞ্চলে কঠোর শরীয়ত ভিত্তিক তরিকতের এই সিলসিলা ব্যাপক বিকশিত হয়।
১৯৯০ দশকের পর থেকে দেশে ব্যাপক উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও অত্যধিক বেড়ে যায়। যার বিরূপ প্রভাব এসে পড়ে তরিকত জগতেও। ফলে বর্তমানকালে যারা তরিকতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তথা পীর বলে প্রচার করছেন, তাদের সাধারণ সচেতন মুসলমানগণের অন্তরের গভীর থেকে কতটুকু শ্রদ্ধা রয়েছে! যেহেতু দুনিয়ার অর্থ ও সম্মানের মোহে বর্তমানকালের পীরগণের মধ্যে অধিকাংশ নিজেকে কতটুকু ঠিক রাখতে পেরেছেন! দুনিয়া বিমুখ হয়ে খালেছ নিয়তে তরিকতের খেদমতে আছেন এমন পীর যে নাই তা নয়। সংখ্যা খুবই নগণ্য।
আজমগড়ী হযরতের জন্মভূমি উত্তর প্রদেশের কোহন্ডা। তিনি পৈত্রিক সুত্রে জমি–জমা পেয়েছেন। এতে চাষাবাদ করে জীবন অতিবাহিত করে গেছেন। তাঁর রয়েছে দ্বিতীল বিশিষ্ট দালান বাড়ি। বাড়ির মাত্র ২০/২৫ মিটারের মধ্যে পারিবারিক এবাদতখানা। ২/৩ শত মিটারের ব্যবধানে পারিবারিক কবরস্থান। এখানে তাঁর দুই বিবি, মা–বাবা, বাবার পীর হযরত শায়খ নেজাবত আলী (রহ.) শায়িত। আজমগড়ী হযরতের পিতা হযরত আবু হামেদ মিয়া করিম বক্স (রহ.) হলেন চিশতিয়া সিলসিলার মহান পীর। তাঁর চিশতিয়া সিলসিলার মুরিদ হলেন বান্ডেল হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর। নিজ একমাত্র পুত্র আজমগড়ী হযরতকে হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুরের নিকট মুরিদ করিয়ে নেন পিতা। আজমগড়ী হযরতের স্ত্রী ইন্তেকাল হওয়ায় সেবা শুশ্রূষার প্রয়োজন পড়ে। গোন্ডা থেকে মেয়ে ও মেয়ের জামাই (মেয়ের জামাই ভাগিনা ) কোহন্ডা এসে গোন্ডায় নিয়ে যান। ১৯৬৯ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর ১৬ রবিউল আউয়াল আজমগড়ী হযরত ইন্তেকাল করলে এই গোন্ডাতেই তাকে শায়িত করা হয়।
আমার বারে বারে কোহন্ডা ও গোন্ডা যাওয়ার সৌভাগ্য হয়ে আসছিল দাদা পীরের প্রতি হৃদয়ের টানে। গত বছর নভেম্বর মাসে এমদাদ উল্লাহকে সাথে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা গমন করি। বিকেলে মানিকতলা রসূলনোমার যেয়ারতে গমন; পরদিন ফুরফুরা ও বান্ডেল যাওয়া হয় যেয়ারতের উদ্দেশ্যে। একদিনের ব্যবধানে রবিবার ১৯ নভেম্বর সকাল ১০ টার ফ্লাইটে কলকাতা থেকে বানারস যাওয়া হয়। রসূলনোমা হযরত ওয়ারেস কাদেরীর যেয়ারতসহ বানারসে সময় দিতে রাত্রিযাপনের প্রোগ্রাম রাখি। বানারস–জৈনপুর–শাহগঞ্জ–কুহন্ডা এলাকায় আজমগড়ী হযরতের অন্যতম খলিফা হযরত সাঈদ খান (রহ.)’র সিলসিলার ব্যাপকতা রয়েছে। এ সিলসিলার দুই জনের সহযোগিতা নিয়ে টেঙী রিজার্ভ করে আমরা সারাদিনের জন্য জৈনপুর অতঃপর শাহগঞ্জ সর্বশেষ কোহন্ডা গমন করি যেয়ারতের উদ্দেশ্যে। টেঙী ভাড়া প্রদান করে দুই সহযাত্রীকে বানারস পাঠাবার ব্যবস্থা করি। সন্ধ্যায় ট্রেনে শাহগঞ্জ থেকে গোন্ডা রওনা হই। আগে পরপর ৪ বার গোন্ডায় আসা হলেও ২৪ ঘণ্টার কম বাদে বেশি সময় দেয়া হয়নি। এইবারে পরপর ৩ রাত থাকা হবে গোন্ডার একটি হোটেলে।
আজমগড়ী হযরতের এ কন্যার ঘরে ৩ পুত্র ৫ কন্যা। ফজলুল বারী (দু’বার এম.এল.এ), জাফরুল বারী শিক্ষক, দু’জনই ইন্তেকাল করে গেছেন। ডা. আবদুল বারী সমাজসেবক অনেকের পরিচিত মুখ, বয়স প্রায় ৮০। কানে মেশিন দিয়ে শুনেন। হুইল চেয়ার দিয়ে চলাফেরা করেন। দীর্ঘ ২৫ বছরের তাঁদের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। সকলেই আমাকে অন্তরের গভীর থেকে শ্রদ্ধার পাশাপাশি করেন মূল্যায়ন। ফজলুল বারী (রহ.)’র প্রথম পুত্র ইঞ্জিনিয়ার জিয়াউল ইসলামকে সাথে নিয়ে দু’বার ডা. আবদুল বারী ছাহেবের সাথে দীর্ঘ বৈঠক করি। আগেও বলেছেন, এইবারও বলছেন, আমার নানা আমার নাম রেখেছেন বান্ডেলের সৈয়দ ছাহেব হুজুরের নামের সাথে মিল রেখে। আমার নানা তরিকতের শায়খ কিন্তু শিরক বিদআত থেকে অনেক দূরে থাকতেন। এখানে গোন্ডায় শিরক বিদআতে ভরপুর। গোন্ডার আশেপাশেও শিরক বিদআত। ভারতে অত্যধিক শিরক বিদআত।
শীতকালে গোন্ডায় অত্যধিক শীত, তাপমাত্রা ২/১ ডিগ্রী নিচে নেমে আসে। গরমকালে অত্যধিক গরম, তাপমাত্রা ৪৪/৪৫ ডিগ্রী উপরে উঠে যায়। ফলে আগত যেয়ারতকারীগণের কল্যাণে যেয়ারতের স্থানে ছাউনী আবশ্যক। কিন্তু ডা. আবদুল বারী কোন অবস্থাতেই সম্মত হলেন না শিরক বিদআত হওয়ার ভয়ে। অবশ্য জিয়াউল ইসলাম আশ্বাস দেন টাইলসসহ যেয়ারতকারীগণের কল্যাণে ন্যূনতম কিছু কাজ করা হবে।
আজমগড়ী হযরতের মাজার থেকে মাত্র শত মিটার মত পশ্চিমে আবাসিক এলাকার ভিতর ৩ কাঠার মত জায়গা রেখেছেন খানকাহ নির্মাণের জন্য।
নাতি ডা. আবদুল বারী ছাহেব আরও বলেন, নানা পৈতিৃক জমিতে কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। তরিকত করে আর্থিক লাভবান হওয়া নানার অপছন্দ। কেন জানি ডা. বারী নানার কথা বললেই বারে বারে আবেগ প্রবণ হয়ে যাচ্ছিলেন, কান্না আসতেছিল। তিনি আরও বলেন, মুরিদরা পীরের সাথে মুসাফাহ করার সময় মুরিদের হাতে টাকা থাকে। মুরিদ পীরকে টাকা দেওয়ার কৌশল। নানা এই টাকা নিতেন না তথায় দিয়ে আসতেন।
৫ বছরের ব্যবধানে গোন্ডা যাওয়ার সময় প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম যেয়ারতকারীর সুবিধার্থে খরচ করার জন্য। কিন্তু ডা. বারীর কথায় মানসিকতায় তা সম্ভব হল না।
বস্তুত আজমগড়ী হযরতের তিন নাতি মরহুম ফজলুল বারী (২ বার এম.এল.এ), মরহুম জাফরুল বারী শিক্ষক এবং ৮০ বছরের বৃদ্ধ ডা. আবদুল বারী তিন ভ্রাতা সন্তান–সন্ততিগণের আমার প্রতি আন্তরিকতা, ভালবাসা, বিশ্বস্ততা আতিথেয়তা আমাকে অভিভূত করে। চলতি সালের শেষের দিকে পুনঃ কোহন্ডা, গোন্ডা যাওয়ার ইচ্ছা রইল।
বস্তুত চট্টগ্রাম অঞ্চলে কঠোর শরীয়ত ভিত্তিক আজমগড়ী সিলসিলা। এ সিলসিলার মধ্যমনি বান্ডেল হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর (রহ.)।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।