হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের ছন

মুহাম্মদ এরশাদ, চন্দনাইশ | মঙ্গলবার , ১২ মার্চ, ২০২৪ at ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ

পাহাড়ি ছনের ছাউনি দেয়া ঘর ছিল খুবই আরামদায়ক। ছনের ছাউনি দেয়া ঘর তীব্র গরমে ঠাণ্ডা আর শীতকালে উষ্ণ গরম রাখতো। সমাজের অভিজাত থেকে দরিদ্র শ্রেণীর প্রায় সব ঘরের ছাউনিই ছিল ছনের। ছন আহরণ ও বিক্রি করে সংসার চালাতো অনেক দরিদ্র পরিবার। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে থেকেই ঘরের পুরোনো ছনের ছাউনি ফেলে দিয়ে নতুন ছন লাগাতে ব্যস্ত সময় পার করতো সমাজের সব শ্রেণীর মানুষরা। বিশেষ করে মাটি ও বাঁশের বেড়ার ঘরের ছাউনিতে ব্যবহার হত পাহাড়ি ছন। ব্যস্ততা ও কদর ছিল ওঁঝাদের। বর্তমানে কিছু কিছু অসচ্ছল মানুষরাই কেবল ছনের ব্যবহার এখনো ধরে রেখেছেন।

চন্দনাইশ উপজেলার ২টি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়নের কোথাও এখন আর ছনের ছাউনি তেমন চোখে পড়ে না। রড, সিমেন্ট, ইট, ঢেউটিনসহ ঘর নির্মাণের অপরাপর উপকরণ সহজলভ্য হওয়ায় মানুষ সেদিকে ঝুঁকে পড়ায় ইতিহাসে স্থান হতে যাচ্ছে পাহাড়ি ছনের। ফলে হাজার বছরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী পরম বন্ধু ছন’র অস্তিত্ব এখন বিলীন হতে বসেছে।

এক সময় চন্দনাইশ উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চল জামিজুরী, জঙ্গল জামিজুরী, হাশিমপুর, জঙ্গল হাশিমপুর, দোহাজারী লালুটিয়া, দিয়াকুল, হাতিয়াখোলা, কাঞ্চনাবাদ, এলাহাবাদ, লট এলাহাবাদ, ছৈয়দাবাদ, ধোপাছড়িতে প্রচুর ছন চাষ হতো এবং প্রকৃতিগতভাবে ছন গাছ জন্ম নিতো। তখন দলে দলে লোকজন ছন খোলায় ছন কাটতে যেতো। বাংলা বছরের আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ছন আহরণ করা হতো। ছন আহরণের পর পর্যাপ্ত রোদে (১৫ থেকে ১৬) দিন শুকিয়ে নিয়ে তা ব্যবহার ও বিক্রির উপযুক্ত করা হতো। বর্তমানে ছনের ব্যবহার কম হওয়ায় ধীরে ধীরে এর চাহিদা কমে যাচ্ছে। ফলে আগের মত ছন চাষ করা হচ্ছে না। অথচ ঐতিহ্যগত এবং পরিবেশগত কারণে ছনের চাষ বৃদ্ধি করা এবং ব্যবহার উচিত বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা।

চন্দনাইশ পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের মৃত ছুন্নু মিয়ার ছেলে মো. আবুল কাসেম (৫৮) জানান, আমরা দেখেছি আশির দশকে ৮০% ঘর ও দোকানের ছাউনি ছিল ছনের। আমাদের মাটির ঘরের ছাউনিও ছিল ছনের। ছনের ছাউনি দেয়া মাটির ঘর ছিল খুবই আরামদায়ক। গরমকালে ঘরকে রাখতে ঠাণ্ডা আর শীতকালে রাখতো উষ্ণ গরম। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমানে মানুষ পাকা বাড়ি, টিনের ছাউনির প্রতি ঝুঁকে পড়ায় হারিয়ে যাচ্ছে সেই ঐতিহ্যের সাক্ষী পাহাড়ি ছন। বর্তমানে দেশের অভিজাত এলাকার বিভিন্ন সংরক্ষিত ও পর্যটন এলাকায় কিছু কিছু ছনের ছাউনি দেখা যায়।

বাঁশখালীর পূর্ব চাম্বল এলাকার বাসিন্দা মো. আবদুর রহিম জানান, এক যুগ আগেও এলাকায় প্রচুর ছনের ছাউনির ঘর দেখা যেত। বর্তমানে ছনের ছাউনির ঘর হারিয়ে যাওয়ার প্রদান কারণ অগ্নি ঝুঁকি। ছনের ঘরে প্রচুর অগ্নিকাণ্ড হতো। তাছাড়া ছন পচনশীল হওয়ায় প্রতিবছরই ঘরের চালায় নতুন ছন লাগাতে হতো। রড, সিমেন্ট, ইট, ঢেউটিন সহজলভ্য হওয়ার ফলে মানুষ আস্তে আস্তে পাকা ঘর, সেমিপাকা ঘর নির্মাণ নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তাছাড়া ঢেউটিন সহজলভ্য পণ্য হয়ে উঠেছে। ফলে নতুন ঘর নির্মাণে টিনের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক সময় বিভিন্ন এলাকার লোকজন চন্দনাইশের দোহাজারী, বাগিচাহাট ও খানহাট এসে পরিমাণ মতো ছন ক্রয় করতো। তবে এখনো অল্পবিস্তর ছন বিক্রি হয় উপজেলার খানহাটে। বর্তমানে প্রতি বার ছন (২ বান্ডেল) প্রকারভেদে ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকায় বিক্রি হয়।

চাষীদের মতে, ঢেউটিনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ছনের কদর কমে গেছে। ছনের ব্যবহার কমে যাওয়ায় পাহাড়ে ছনের চাষাবাদও কমে গেছে। ছন এখন অনেকটা বিলুপ্তির পথে। তারপরও গ্রামবাংলার কিছু অতি সাধারণ মানুষ এখনো ছনের ছাউনি সম্বলিত ঘর ব্যবহার করে পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমহানগর ছিন্নমূল সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদের আলোচনা সভা
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় বন্য হাতি দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্তদের চেক বিতরণ