বঙ্গোপসাগরে দাপট দেখাচ্ছে জেলিফিশ। সাগরে ‘জেলিফিশ ব্লুম’ ঘটায় অন্যান্য প্রজাতির মাছ এলাকাছাড়া হয়ে গেছে। এতে করে সাগরে মাছ শিকারে নিয়োজিত ফিশিং জাহাজ এবং ট্রলারগুলো মাছ ছাড়াই ফিরে আসছে। শুধু মাছের আকাল নয়, জেলিফিশ জেলেদের ভোগান্তিরও কারণ হয়ে উঠছে। প্রাকৃতিক কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে সমুদ্রবিজ্ঞানীরা বলেছেন, জেলিফিশের দাপট না কমলে মাছের স্বাভাবিক বিচরণ ঘটবে না।
সূত্রে জানা যায়, বেশ কিছুদিন ধরে সাগরে প্রচুর জেলিফিশ দেখা দিয়েছে। জেলেদের জাল ভর্তি হয়ে উঠছে জেলিফিশ। জেলিফিশ ছোট মাছগুলো খেয়ে ফেলে। এতে করে সাগরের যে এলাকায় জেলিফিশ দেখা দেয় সেখানে ছোট মাছগুলো পালিয়ে যায়। একইভাবে সরে পড়ে অন্যান্য মাছও। জেলিফিশের একক রাজত্বে পরিণত হয় সাগর। বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত এলাকা গত বেশ কিছুদিন ধরে জেলিফিশের দখলে চলে গেছে।
জেলিফিশকে ‘ফিশ’ বলা হলেও মূলত এটি মাছ নয়। এটি এক ধরনের অমেরুদণ্ডী প্রাণী। পৃথিবীর সব সাগর, উপসাগর এবং মহাসাগরে জেলিফিশ রয়েছে। ঘণ্টাকৃতি জেলি সদৃশ প্রাণীটি প্রাণীজগতের নিডারিয়া পর্বের সিফোজোয়া শ্রেণীর অন্তর্গত। এটি অনেকটা কলসির মতো। এক কেজি থেকে ১৪/১৫ কেজি ওজনের জেলিফিশও বঙ্গোপসাগরে ধরা পড়ে। পৃথিবীতে আড়াই থেকে তিন হাজার প্রজাতির জেলিফিশ রয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র ২২ প্রজাতির জেলিফিশ চীন, হংকং কোরিয়াসহ কিছু দেশের মানুষ খায়। এগুলো বিষাক্ত নয়। বঙ্গোপসাগরে ধরা পড়া জেলিফিশ বিষাক্ত না হলেও এগুলো রপ্তানি করার মতো অবকাঠামো এদেশে গড়ে উঠেনি। জেলেদের জালে বিভিন্ন সময় জেলিফিশ ধরা পড়লেও এগুলো সাগরে ফেলে দেওয়া হয়।
কিন্তু গত কিছুদিন ধরে জেলিফিশের দাপট বেড়ে গেছে। হাজার হাজার জেলিফিশ সাগরের বিস্তৃত এলাকায় বিচরণ করছে। জেলেরা জাল ফেললেই টনে টনে জেলিফিশ উঠে আসছে। এগুলো জাল থেকে আবার সাগরে ফেলে দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। জেলিফিশের দাপটে অন্যান্য মাছ সরে যাওয়ায় সাগরে নিয়োজিত মাছ ধরার বড় বড় জাহাজ এবং ট্রলারগুলো অনেকটা শূন্য হাতে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
এস এম মামুন মিয়া নামে এক জাহাজ মালিক গতকাল আজাদীকে বলেন, পরিস্থিতি ভয়াবহ। গত ৩০ বছরে এমন বিপর্যয় দেখিনি। জাল ফেললেই উঠছে জেলিফিশ। এতো জেলিফিশ ধরা পড়ছে যে, জেলেদের জাল উদ্ধার করে আনাও কষ্টকর হয়ে উঠছে।
মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম নামে এক ফিশিং ভ্যাসেল মালিক বলেন, জেলিফিশ নিয়ে বিড়ম্বনার মধ্যে আছি। মাছ তো পাই না, উল্টো জাল থেকে জেলিফিশ ছাড়াতে জেলেদের কষ্ট হচ্ছে। জেলিফিশের কারণে সাগরের এই অঞ্চল মাছশূন্য হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, সমুদ্রের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে জেলিফিশের সংখ্যার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটলে তাকে ‘জেলিফিশ ব্লুম’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এটিকে জেলিফিশের উচ্চ প্রজননের ফলাফল হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি, সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ইউট্রোফিকেশন, হাইপোঙিয়া, উপকূলীয় উন্নয়ন এবং অতিরিক্ত মাছ ধরাকে জেলিফিশ ব্লুমের জন্য দায়ী করা হয়। সাগরে সামুদ্রিক কাছিমের সংখ্যা কমে গেলেও জেলিফিশের বিস্তার ঘটে। জেলিফিশ সামুদ্রিক কাছিমের প্রিয় খাবার বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী সাগর–মহাসাগরগুলোতে সাধারণত বসন্ত ও গ্রীষ্মে বেশি জেলিফিশ ব্লুমের ঘটনা ঘটে। কারণ উষ্ণ জলের তাপমাত্রা জেলিফিশকে দ্রুত যৌন পরিপক্বতায় পৌঁছায় এবং অবিশ্বাস্য গতিতে উচ্চ প্রজনন ঘটায়। বিশ্বব্যাপী মহাসাগরের তাপমাত্রার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি জেলিফিশের সংখ্যা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে।
বর্তমানে সারা বিশ্বে জেলিফিশ ব্লুম মৎস্যজীবীদের কাছে আতংকের নাম এবং গবেষকদের জন্য দুঃচিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, জেলিফিশ ব্লুমের কারণে সাগরের বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, মাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। ট্রলিং নেট বা মাছ ধরার জালে মাছের পরিবর্তে হাজার হাজার জেলিফিশ আটকা পড়ে জেলেদের ভোগান্তির কারণ হয়। দুর্বল প্রকৃতির এই প্রাণী সামান্য আঘাতে কিংবা জালে আটকা পড়ার সাথে সাথে মারা যায়। বাজারমূল্য না থাকায় জেলেরা এ সকল মৃত জেলিফিশ সাগরে ফেলে দেয়। যাতে সাগরের পরিবেশ এবং জোয়ারে ভেসে এসে উপকূলের পরিবেশ নষ্ট করে। সমুদ্রসৈকতগুলো জেলিফিশের পচা গন্ধ পর্যটকদের নিকট বিরক্তির কারণ হয়ে উঠছে।
তিনি বলেন, বিশ্বে জেলি ফিশের ৩৬২ বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে। আমরাও এই অবহেলিত সামুদ্রিক পণ্যটির স্থানীয় বাজার সৃষ্টিসহ রপ্তানি করে সুনীল অর্থনীতিতে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারি।