ডিজিটাল বাংলাদেশ–এর সফল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় আমরা এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ হিসেবে আত্নপ্রকাশের মিশনে আছি। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে চারটি ভিত্তি নির্ধারিত হয়েছে। ১. স্মার্ট নাগরিক ২. স্মার্ট অর্থনীতি ৩. স্মার্ট সরকার ৪. স্মার্ট সমাজ। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’–এর নাগরিক, সমাজ, অর্থনীতি ও সরকার হবে স্মার্ট। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কার্যক্রম হবে স্মার্ট পদ্ধতিতে। আর সেই লক্ষ্যে সরকার ব্যবস্থার আধুনিকীকরণসহ সব ক্ষেত্রের সমন্বিত উন্নয়ন সাধন করতে হবে আর সেই ক্ষেত্রে দেশের প্রতিটি মানুষের অন্তর্ভুক্তি একান্ত অপরিহার্য। নাগরিকদের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। তারা আজ ঘরের কাজের সঙ্গে শিক্ষা, কৃষি, অর্থনীতি, উৎপাদন, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনসহ সব ক্ষেত্রে সমান দক্ষতার এগিয়ে যাচ্ছেন।
স্মার্ট বাংলাদেশের প্রথম ভিত্তি ‘স্মার্ট নাগরিক’। ‘স্মার্ট নাগরিক’ তৈরির প্রাথমিক ক্ষেত্র পরিবার, আর প্রধান উপায় শিক্ষা। জন্মের পর থেকে মা–ই শিশুকে সুস্থ–সবল–শিক্ষিত করার ভিত্তি রচনা করেন। পরিবার, রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক। পরিবার থেকে ক্রমে সমাজ ও রাষ্ট্র। আর পরিবার সন্তানের প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সেই প্রতিষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক মা। সুতরাং সন্তানের শিক্ষায় মা সরাসরি কার্যকর প্রভাব রাখেন। অর্থাৎ মা স্মার্ট হলে সন্তান স্মার্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। প্রাথমিকে নারী শিক্ষক ৬৪ শতাংশের বেশি। এই অধিক সংখ্যক নারী শিক্ষক, সন্তানতুল্যে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে শিক্ষার বীজ রোপণ করছেন। তথ্য মতে, প্রাথমিকে ৬৪.২ শতাংশ, মাধ্যমিকে ২৮.৮৯ শতাংশ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২৯ শতাংশ নারী শিক্ষক রয়েছেন। চিকিৎসা পেশায় নারীদের অবস্থান প্রায় ৫৫ শতাংশ। প্রকৌশলেও নারীরা পিছিয়ে নেই। ‘স্মার্ট নাগরিক’ তৈরিতে নারীই মুখ্য ভূমিকা রাখছেন। শিক্ষার সব স্তরে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যাধিক্য বিদ্যমান। ব্যানবেইসের তথ্য মতে, প্রাথমিকে নারী শিক্ষার্থী ৫১ শতাংশ, মাধ্যমিক স্তরে ৫৪ শতাংশ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৫২ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। আজকের এই শিক্ষার্থীরা, শিক্ষাক্ষেত্রসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে স্মার্ট তথা দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
‘স্মার্ট বাংলাদেশে’র দ্বিতীয় ভিত্তি ‘স্মার্ট অর্থনীতি’বর্তমানে নারীরাই অর্থনেতিক সমৃদ্ধির অন্যতম চালিকা শক্তি। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান উৎস পোশাক শিল্প। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে পোশাক শিল্প থেকে। আর পোশাক শিল্পে নারী প্রায় ৭০ শতাংশ। অর্থনীতির দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠনো বৈদেশিক অর্থ। সে ক্ষেত্রেও নারীরাই অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন অনেক বছর ধরে। ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নারীর অন্তর্ভুক্তির কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষায় শুধু নয়, পেশায় প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারীরা ঘরে বসে ব্যবসা করছেন। অনলাইনে দেশ–বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করছেন, কেউবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করছেন। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশান অব সফটওয়ার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) মতে, দেশে মোট ৩ লাখ মানুষ অনলাইন ব্যবসায়ে যুক্ত, যাদের অর্ধেকই নারী। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর তথ্যমতে, দেশের ৫৮৬৫টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করছেন একজন করে নারী। ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’র তৃতীয় ভিত্তি ‘স্মার্ট সরকার’। স্মার্ট প্রশাসন, স্মার্ট হেলথকেয়ার, ব্লেন্ডেড লানিং, স্মার্ট কৃষি, স্মার্ট বিচারিক ব্যবস্থা, স্মার্ট পেমেন্ট সিস্টেম। আর সে ক্ষেত্রে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। কারণ অর্ধ শতাব্দী বয়সি বাংলাদেশে মোট আটবার সরকারপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকারও নারী, একাধিকবার বিরোধীদলীয় নেতাও হয়েছেন নারী। জাতীয় সংসদের মোট আসন সংখ্যা ৩৫০, এর মধ্যে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সরাসরি নির্বাচিত নারী সংসদ ১৪ জন। স্থানীয় সরকারে রয়েছে নারীর সক্রিয় উপস্থিতি। মোট ১২টি সিটি মেয়র পদে দুজন নির্বাচিত নারী মেয়র আছেন। উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত নারী চেয়ারম্যান ৪৫ জন। বর্তমানে স্থানীয় সরকারে এক–তৃতীয়াংশ নারী আসন সংরক্ষিত আছে, সেখানে মোট ১৮ হাজার নারী জনপ্রতিনিধি দায়িত্ব পালন করছেন। নারী সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকারের নারী প্রতিনিধিরা জাতীয় নীতিনির্ধারণে যেমন ভূমিকা রাখছেন তেমন তারা নারীর সমস্যা–সংকট নারীর দৃষ্টি দিয়ে দেখে সেসব সমস্যার সমাধানে যথাযথ পথ নির্দেশ করে থাকেন। নারীর প্রযুক্তি শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে পলিটেকনিকে নারীর জন্য ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে। পুলিশ, সেনা, বিমান, নৌবাহিনী ও আনসারে নারীরা সক্রিয় ভূমিকায় আছেন। সেনাবাহিনীতে নারী মেজর জেনারেল, পুলিশে অতিরিক্ত আইজিপি, অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী পুলিশ সুপারসহ, পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী পুলিশ বাহিনীতে ১৫ হাজার ১৬৩ জন নারী রয়েছেন। প্রশাসনে নারী ২৬ শতাংশ, সেবা খাতে ৩৭ শতাংশ। মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের ২০২০ সালের তথ্য মতে, নারী নার্স ৯০.৬ শতাংশ। কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসা, সেবা, প্রযুক্তি, শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনীতি, নীতিনির্ধারণ, প্রতিরক্ষাসহ দেশ পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে নারী ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছেন।
‘স্মার্ট বাংলাদেশে’র চতুর্থ ভিত্তি ‘স্মার্ট সমাজ’। নারী ‘স্মার্ট সমাজ’ গঠনের অন্যতম প্রধান নিয়ামক। ‘স্মার্ট সমাজ’ গঠনের পথে সুযোগ্য পথ নির্দেশক জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা–এর নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা।
২০১৭ সালের গ্লোবাল ফিনডেঙ ডাটা এবং ২০১৮ সালের আইএফসির সার্ভে ডাটা সূত্রে বাংলাদেশে ৬৫ থেকে ৬৮ শতাংশ উপার্জনক্ষম নারী আর্থিক সেবার বাইরে রয়েছেন। গ্লোবাল ফিনডেক্স ডাটার তথ্যমতে, বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান পুরুষের চেয়ে ২৯ শতাংশ পিছিয়ে।
নারীরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে আসছেন, কিন্তু তাঁরা অর্থ ব্যবহার করছেন কি না, সে বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। নারীদের মধ্যে যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁরা ভালোভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে আছেন। শুধু ঋণ নিলে বা হিসাব খুললেই নারীরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে আসবেন না। নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করে স্বাবলম্বী করতে হবে। উদ্যোক্তাদের বড় সমস্যা হচ্ছে, পণ্য পরিবহন ও বাজারজাতকরণ। এ জন্য অনেকে সফল হতে পারছেন না। এসব ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। শুধু আয় দারিদ্র্য দূর করলেই যে একজন নারী ভালো থাকবেন তা কিন্তু নয়। তার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পারিবারিক সংস্কৃতি এমন অনেক কিছু বিবেচনা করতে হয়। এসডিজি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজন নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি।
দেশের অর্ধেক নারী। তাঁরা শ্রমবাজারে আসছেন। তবে আরও বেশি করে আসা প্রয়োজন। শ্রমবাজারে এখন নারীর অংশগ্রহণ ৩৬ শতাংশ। আশার কথা এই যে, দক্ষিণ এশিয়ায় এমনকি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নারীরা ভালো করছেন। তবে নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশি করে যুক্ত করতে হবে। আর নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে দুটি কাজ করতে হবে। এক. তাঁকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে হবে। দুই. কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁকে যোগাযোগ করিয়ে দিতে হবে। এ দুই জায়গাতেই নারীর বাধা রয়েছে। একজন নারীকে অনেক সময় নিয়ে ঘরের কাজ করতে হয়। এটি তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা। নারীদের আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্তি জোরদার করতে জেন্ডার বিভাজিত তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা জরুরি, যা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কেবল নীতিমালা থাকাই যথেষ্ট নয়। তাঁরা যেন সহজে ব্যাংকঋণ নিতে পারেন, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ডিজিটাল সেবায় নারীর অংশগ্রণের পথ সহজ হতে হবে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক সিদ্ধান্তে নারীর অংশগ্রহণ, নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যেন তিনি কেবল ঋণের বোঝা বহনকারী না হন। সামগ্রিকভাবে নারীর পিছিয়ে থাকা অবস্থার পরিবর্তন না আনতে পারলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতেও তাঁর শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এই লক্ষ্যে সাবইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে আমাদের নারী উদ্যোক্তাদের কখনো ব্যর্থ হতে দেখিনি। একটি উদ্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নতুন অন্য একটি উদ্যোগ নিয়ে নারী উদ্যোক্তারা সফল হয়েছেন। এছাড়া আমরা দেখেছি, নারী উদ্যোক্তাদের সফল হওয়ার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি খুব অল্প পুঁজিতেও তারা নিজেদের এগিয়ে নিতে পারেন। আমরা নারীর উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা বলছি। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কথা বলছি। আমরা সব ধরনের আর্থিক কর্মকাণ্ডে নারীর আরও অংশগ্রহণ চাই। বিশেষ করে, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নির্মাণে নারীরা সফল ও সর্বমুখী ভূমিকা রাখতে পারে। নারীর অধিক অংশগ্রহণে ‘স্মাট নাগরিক’, ‘স্মাট অর্থনীতি’, ‘স্মার্ট সরকার’ ও ‘স্মার্ট সমাজ’ গঠিত হয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে–এই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : নারী নেত্রী, উদ্যোক্তা ও সংগঠক।