কালুরঘাট সেতু চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর প্রায় ১০০ বছর আগে নির্মিত প্রথম সেতু। স্থানীয়ভাবে অনেকের কাছে ‘হালুরঘাডর পোল’ হিসাবে অধিকতর পরিচিত। কালুরঘাট সেতু বা ব্রীজ হলো বাংলাদেশের চট্টগ্রামের শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কর্ণফুলী নদীর উপর স্থাপিত একটি লৌহ নির্মিত সেতু। এটি চট্টগ্রামের অন্যতম দর্শনীয় এবং ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে সবার কাছে পরিচিত। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও এই সেতু দিয়ে পারাপার হয়েছে স্থানীয়রা। এর পর স্বাধীন দেশের নাগরিকরাও ব্যবহার করছে এ সেতু। কর্ণফুলী নদীর ওপর ১৯৩০ সালে নির্মিত কালুরঘাট সেতুটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ঊঠেছে। বার বার সংস্কারের মাধ্যমে এ সেতুটির ওপর দিয়ে রেলসহ বিভিন্ন ভারী যানবাহন চলাচল করানো হচ্ছে। ফলে ঘটতে পারে মারাত্মক ও ভয়াবহ দুর্ঘটনা। চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৩০–৩৫ লাখ মানুষ ১৯৯১ সাল থেকে কালুরঘাটে একটি দ্বিমুখী রেলওয়ে কাম–সড়ক সেতুর দাবি জানিয়ে আসছেন। তাঁদের দাবির সঙ্গে পূর্ণ সংহতি জানান স্থানীয় সাংসদগন এবং সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা। প্রতিবারই প্রতিশু্রতি দেওয়া হয় আশ্বস্ত করা হয় কিন্তু নতুন সেতু দৃশ্যমান হয় না। নতুন সেতুর বাস্তবায়ন ও নির্মাণ বছরের পর বছর ঝুলে আছে। সেতুটির জন্য অপেক্ষা করছে হতাশাগ্রস্ত বোয়ালখালীবাসী। তারা আশায় আছে। চট্টগ্রামের উন্নয়নের যে কর্মযজ্ঞতা অব্যাহত রয়েছে সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারের সফল প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের গণমানুষের প্রাণের দাবি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর বোয়ালখালী–কালুরঘাটে নতুন সেতুর দৃশ্যমান চাই।
বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধনী দিনের মতো আরও একটি উন্নয়ন–ঝলমলে দিন দেখতে চান চট্টগ্রামবাসী সেটা নতুন কালুরঘাট সেতু উদ্বোধনের দিন। সেই দিন চলতি দশকের মধ্যেই আসুক। এই আশা যেন আর হতাশায় পরিণত না হয়। টানেল হয়ে গেছে মাত্র সাড়ে চার বছরে। কালুরঘাট সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ১০ বছরেও হয় না। সকল প্রশ্ন উপেক্ষা করে বলতে চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন সারথি কালুরঘাট কাম–সড়ক সেতু নির্মাণ করে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম কে আরো বেগবান করবেন।
স্বাধীনতার ৫২ বছরে বাংলাদেশের অর্জন : বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে দ্রুতগতিতে অগ্রসরমান। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হল অদম্য সাহসিকতার পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, উড়াল সেতু, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায়ন, মহামারি–সংকট মোকাবেলায় দক্ষতা, স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা তৈরি, যোগাযোগ খাতের ব্যাপক উন্নয়ন, রুপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুতে কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু সাটেলাইট–১ উৎক্ষেপণ, সল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময়, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানার বিরোধ নিষ্পত্তি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সারাদেশে একশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণকাজ, ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা, মাথাপিছু আয় ৩০০ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলার, এখানেই শেষ নয় আমদানি–রফতানি বাণিজ্য, বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠা, ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে মানবিক আশ্রয় দেওয়া, শিক্ষা–স্বাস্থ্য–নারী ক্ষমতায়নে বিশ্বে নজির স্থাপন করেছে সোনার বাংলা এবং এসডিজির লক্ষ্য পূরণে ঈর্ষণীয় সাফল্য।
জানা গেছে–১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টের সেনা পরিচালনার জন্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট এলাকায় একটি আপদকালীন সেতু তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৩০ সালে বু্রুনিক অ্যন্ড কোম্পানির ব্রিজ কোম্পানি ব্রিজ বিল্ডার্স–হাওড়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান এ সেতু তৈরি করে। জরুরি ভিত্তিতে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে নির্মিত ৭০০ গজ লম্বা সেতুটিতে ছয়টি ব্রিক পিলার ১২টি স্টিল পিলার দুটি অ্যবটমেন্ট ও ১৯টি স্প্যান রয়েছে। সেতুটি উদ্বোধন করা হয় ১৯৩০ সালের ৪ জুন। পরে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পুনরায় বার্মা ফ্রন্টের যুদ্ধ মোটরযান চলাচলের জন্য ডেক বসানো হয়। দেশ বিভাগের পর ডেক তুলে ফেলা হয়। এই একমুখী যুদ্ধ সেতুটিতে সব ধরনের যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় ১৯৫৮ সালে।
বোয়ালখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৩০–৩৫ লাখ মানুষের অন্যতম ভরসা এই একমুখী রেল সেতুটি। সেতু দিয়ে যান চলাচল, পায়ে হেঁটে পারাপার এবং রেল চলাচল করে থাকে। একমুখী চলাচলের কারণে দুই পাশে যানজট হওয়ার পাশাপাশি সেতুর ওপর চাপও বেড়েছে। স্থানীয় লোকজন বলছে–চীনের দুঃখ ছিল হোয়াংহো নদী, বাংলাদেশের দুঃখ তিসতা চুক্তি, বোয়ালখালী ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের দুঃখ কালুরঘাট সেতু! যার একদিক থেকে গাড়ি উঠলে অন্যদিক থেকে আর গাড়ি আসতে পারেনা। প্রতিদিন একজন মানুষ যিনি নিয়মিত শহরে যাতায়াত করেন গড়ে ষাট বছর বাঁচলে দৈনিক এক ঘন্টা হিসেবে তার জীবনের ২১ হাজার ৯শ ঘন্টা সময় এই ব্রীজ কেড়ে নিচ্ছে। বোয়ালখালী উপজেলার লোকজন বলছে কত মানবেতর জীবন যাপন বোয়ালখালীবাসী অতিবাহিত করছে তা ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ এতদাঞ্চলের মানুষের মৃত্যু যে কত কাছে তা কালুরঘাট ব্রীজ দেখেই বাইরের লোকজন অনুমান করে ফেলে। ব্রিজের জ্যামে আটকা পড়ে হাসপাতালে নিতে দেরি হওয়ায় কেউ মাকে কেউ বাবাকে কেউ ভাইকে কেউ বোনকে কেউ কলিজার টুকরা সন্তানকে কেউ আত্মীয়কে কেউ স্ত্রীকে কেউ স্বামীকে অকালে হারিয়েছেন। কত বোন কত মাযে এই ব্রিজের জ্যামে গাড়িতেই তার সন্তান প্রসব করেছে তার হিসাব মিলানো বড় মুশকিল। ঈদ বলুন, কোরবান বলুন, পূজা বলুন সব কিছুর আনন্দকে এই ব্রিজের কাছেই বলি দিতে হয়। এই স্থানে সারা দিন এমনকি মধ্যরাত পর্যন্ত মানুষের কোলাহল থাকে। সেতু পারের জন্য কর্ণফুলীর দুই তীরে অপেক্ষমাণ যানবাহনের দীর্ঘ সারি থাকে। এখানে এলেই যেকোনো সময় শত শত মানুষের উদ্বিগ্ন মুখ প্রত্যক্ষ করবেন, কার আগে কে যাবে, কে উঠবে তাড়াতাড়ি সেতুর ওপর, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা, বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার থেকে শুরু করে নানা যানবাহন নিয়ে সারা দিন এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করে সেখানে। চলে এক আশ্চর্য প্রতিযোগিতা।
বোয়ালখালী–কালুরঘাট নতুন সেতু নির্মিত হলে বোয়ালখালী ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের উন্নয়নের দ্বার খুলে যাবে। শিল্প–কারখানা গড়ে উঠবে। অর্থনীতির চাকা সচল হবে। অতি কম সময়ে মানুষ শহরে আসা–যাওয়া করতে পারবে। রেল কাম সড়ক সেতু করতে হবে। তাহলে বোয়ালখালী ও পটিয়ার পূর্বাঞ্চল অর্থনৈতিক জোনে পরিণত হবে। চট্টগ্রাম শহরের উপর চাপ কমবে। সেতু নির্মিত হলে পর্যটন নগরী কক্সবাজার টেকনাফ ও পার্বত্য জেলা বান্দরবানসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের ১৭ সড়কে যানবাহনের চাপ ও যানজট নিরসনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এটি নির্মিত হলে চট্টগ্রামবাসী দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি এবং অর্থনীতির দ্বার খুলে যাবে। বর্তমানে যেখানে ১ঘন্টা, ২ঘন্টা ও অনেক সময়ে ৩ঘন্টাও যানজটে আটকে থাকতে হয় সেখানে দ্বিমুখী নতুন সেতু হলে ৫মিনিটেই শহরে পৌঁছা যাবে। এটি নির্মিত হলে নিরবচ্ছিন্ন রেল পরিবহন সেবা নিশ্চিত করা যাবে এবং চট্টগ্রাম–কক্সবাজার করিডোরের অপারেশনাল বাধা দূর হবে। নতুন সেতু নির্মিত হলে পর্যটন নগরী কক্সবাজার, টেকনাফ ও পার্বত্য জেলা বান্দরবানসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম ঘিরে শিল্পায়ন ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে–এমনটাই প্রত্যাশা সকলের। নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগে নদীর দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে নতুন করে আশার আলো দেখা দিয়েছে। বোয়ালখালী–পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের একাংশের বন্দর নগরীর সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এই কালুরঘাট সেতু। নতুন সেতু নির্মাণ হলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম–বান্দরবান ও কক্সবাজার এলাকার সাথে চট্টগ্রাম নগরীর যোগাযোগ আরো সহজ হবে। বোয়ালখালী উপজেলা পরিণত হবে চট্টগ্রামের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী, দর্শনীয় ও পর্যটন–এলাকা হিসাবে।
প্রয়াত এমপি বাদল–মোছলেম ও সাবেক এমপি নোমান আল মাহমুদ কারো হাত দিয়েই হয়নি এই সেতু! সদ্য বিজয়ী নতুন সরকারের এমপি আব্দুচ ছালামও বলেছেন তিনি এই সেতুর নির্মাণ বাস্তবায়নে কাজ করবেন। বোয়ালখালীবাসীর দুঃখ ঘুচাবে কে? কার হাতে হবে এই সেতু? প্রশ্ন থেকেই যায়। বাংলাদেশ সরকারের সফল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন ছাড়া যেভাবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত সম্পন্ন করেছেন তা বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে। তিনি বেঁচে থাকুক শতবছর, তিনি বেঁচে থাকলেই অদম্য গতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। চট্টগ্রামের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা এবং তাঁর নির্দেশে বাংলাদেশে উন্নয়নের যে কর্মযজ্ঞতা অব্যাহত রয়েছে সেই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামবাসী, দক্ষিণ চট্টগ্রাম, বোয়ালখালী ও পটিয়া উপজেলার পূর্বাংশের লক্ষ লক্ষ মানুষের দৃঢ বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের সময়েই বোয়ালখালী–কালুরঘাট সেতু নির্মাণের দৃশ্যমান কার্যক্রম শুরু হবে। ইনশাআল্লাহ।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট