মর্মস্পর্শী ‘গল্প’ রেখে চলে গেলেন যারা

| শনিবার , ২ মার্চ, ২০২৪ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

কথা ছিল, পরিবার নিয়ে ইতালি চলে যাওয়ার আগে শুক্রবার মাকে দেখতে গ্রামের বাড়ি যাবেন ছেলে। সেজন্য ছেলের পছন্দের খাবারের বাজারসদাই করিয়ে রেখেছিলেন বৃদ্ধা মা। রাত পোহালেই বাড়িটির সদস্যদের আনন্দে মেতে উঠার আয়োজন ছিল; সেখানে আজ মায়ের বুকফাটা আর্তনাদে প্রতিবেশীদেরও চোখের জল আটকে রাখা কঠিন হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতে গ্রিন কোজি কটেজে নিহত ৪৬ জনের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের শাহবাজপুর গ্রামের একই পরিবারের পাঁচজন রয়েছেন। তারা হলেন ইতালি প্রবাসী সৈয়দ মোবারক হোসেন (৪৮), তার স্ত্রী স্বপ্না বেগম (৩৫), তাদের দুই মেয়ে সৈয়দা কাশফিয়া (১৭) ও সৈয়দা নূর (১২) এবং ছেলে সৈয়দ আব্দুল্লাহ ()। পরিবার জানিয়েছে, দেশ ছাড়ার আগে মোবারক স্ত্রীছেলেমেয়েকে নিয়ে একসঙ্গে খেতে গিয়েছিলেন গ্রিন কোজি কটেজে বিরিয়ানির দোকান কাচ্চি ভাইয়ের শাখায়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেখানেই যাওয়াই কাল হল মোবারক হোসেনের। পরিবারের পাঁচজনের সবাই এখন লাশ।

ভিকারুন্নেসা স্কুলের শিক্ষক লুৎফুন নাহার ও তার মেয়ে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী জান্নাতি তাজরীনকে মর্গের লাশের ভিড়ে খুজে পেলেন লুৎফুন নাহারের স্বামী গোলাম মহিউদ্দিন। সেখানে তিনি আফসোস করছিলেন। বলছিলেন, তার স্ত্রী দাঁতের ব্যথায় ভুগছিলেন। দাঁত দেখাতে তারা হাসপাতালে যান। ফেরার পথে মহিউদ্দিনের ইচ্ছাতেই তারা কাচ্চি খেতে যান। সেখান থেকে লাশ হয়ে ফিরতে হবে এমন ভাবনা কে ভেবেছে!

সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসের বিকালে ছেলেমেয়েকে নিয়ে বইমেলায় গিয়েছিলেন পপি রাণী রায় (৩০)। ফেরার পথে গিয়েছিলেন বেইলি রোডে ‘কাচ্চি ভাই’ নামের দোকানে বিরিয়ানি খেতে। কিন্তু আদরের সন্তানদের নিয়ে তিনি যে শেষবারের মতো খাবারের টেবিলে বসেছিলেন, তা কী ঘুণাক্ষরেও বুঝেছিলেন? খেতে গিয়ে লাশ হয়েছেন পপ রাণী রায়, তার মেয়ে আদ্রিজা (১২) আর ছেলে তূর্য ()। গতকাল শুক্রবার সকালে বোন, ভাগ্নেভাগ্নির লাশ বুঝে নেন পপির ভাই রিংকু রায়। তিনি বলেন, (বোন, ভাগ্নেভাগ্নি) সারভাইভ করে পঞ্চম তলা পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু অঙিজেন লেভেল জিরো হয়ে যাওয়ার কারণে তারা আর সারভাইভ করতে পারেনি। শুনেছি পপি তার ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। কিন্তু জীবত অবস্থায় বের হয়ে আসতে পারেনি।

মালয়েশিয়ায় ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়তেন রিয়া। লাস্ট সেমিস্টারের শিক্ষার্থী তিনি। ২ মার্চ (আজ) তার ফ্লাইট। ভিকারুননেসা পড়ুয়া ছোট বোন আলিসা ও সিটি কলেজে পড়ুয়া খালাতো বোন লিমুকে নিয়ে খেতে এসেছিলেন। রিয়ার বাবা কোরবান আলী পাগলের মত ঘুরছিলেন মেয়েদের খোঁজে। অবশেষে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের মর্গে মিলল তিন বোনের লাশ। পাগলের মত আচরণ করছিলেন কোরবান আলী। তার মধ্যে আপন দুই বোনকে পাশাপাশি কবরে দাফন করা হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টায় তাদের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হলে স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে বাড়ির পরিবেশ। রিয়া ও আলিসাকে একনজর দেখতে ভিড় করে শত শত মানুষ। কোরবান আলী বলেন, রিয়া মালেয়শিয়া ফিরে যাবে। তাই দুবোন এবং আমার ভায়রা ভাইয়ের মেয়েসহ প্রথমে তারা পিৎজা হাটে যায়; সেখানে কার্ডও পাঞ্চ করে। তাই আগুনের ঘটনা শুনে প্রথমে আমরা নিশ্চিত হই যে, আমার মেয়েরা ভালো আছে। পরে হঠাৎ ফোন আসে। মেয়েরা চিৎকার করতে করতে বলে বাবা আমরা বেইলি রোডে কাচ্চি ভাইয়ে আছি, এখানে আগুন লাগছে। আমাদের বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল। দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখি তিনজনের মরদেহ পড়ে আছে। তিনি বলেন, আমার দুই সন্তান দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। এ রকম মর্মান্তিক মৃত্যু আল্লাহ কী কারণে দিয়েছেন, সেটা আল্লাহই ভালো জানেন।

গ্রিন কোজি কটেজে আগুনে প্রবাসী উত্তম রায়ের স্ত্রী রুবি রায় (৪০) এবং মেয়ে ভিয়াংকা রায় (১৭) মারা যায়। উত্তম পোল্যান্ড চলে যাওয়ার পর রুবি রায় তার মেয়ে ভিয়াংকাকে নিয়ে ঢাকার মালিবাগে বসবাস করতেন। রুবি ফিলিপিন্সের নাগরিক ছিলেন। তার মেয়ে ভিয়াংকা ঢাকায় এ লেভেলে পড়াশোনা করত। উত্তমের ভাগ্নে অয়ন রায় বলেন, ঘটনার দিন রাতে মালিবাগের বাসা থেকে মা ও মেয়ে বেইলি রোডের ‘কাচ্চি ভাইয়ে’ খেতে গিয়েছিলেন। খাবার শেষে বাসায় ফেরার কথা থাকলেও সেটি আর সম্ভব হয়নি। আগুন তাদের স্বপ্ন ছাই করে দিয়েছে।

কানাডা থেকে ফেরা বোনের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা গিয়েছিলেন মুন্সীগঞ্জের মেয়ে জারিন তাসনীম খান প্রিয়ন্তী। কিন্তু বেইলি রোডের রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে তিনি ফিরছেন লাশ হয়ে। বৃহস্পতিবার রাতে বড় বোন সুহা তাকে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়েছিলেন ডিনার খাওয়াতে। সঙ্গে ছিল সুহার মেয়ে ও মামী শাশুড়ী। কিন্তু আগুন লাগার পর অন্য তিনজন বের হতে পারলেও পারেননি প্রিয়ন্তী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচবির ভর্তি পরীক্ষা আজ শুরু
পরবর্তী নিবন্ধরেস্তোরাঁয় স্বামীর অপেক্ষায় থাকা নাজিয়া ২ ছেলেসহ মারা গেলেন