ইসলামের মৌলিক ফরজ বিধানগুলোর মধ্যে যাকাত অন্যতম একটি ফরজ বিধান। আল্লাহতায়ালা যাকাত প্রদানকে মুসলমানদের উপর ফরজ করে দিয়েছেন। এটি সমাজের ধনী–গরীবদের যে অসামঞ্জস্যতা, তা দূরীভূত করতে সহায়তা করে এবং এটি বৈষম্যহীন একটি অর্থনৈতিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যাকাতের মাধ্যমে বান্দার সম্পদ পবিত্র হয়। এমনকি সম্পদ বৃদ্ধি পায়। আর সেজন্য আল্লাহর কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে সামর্থ্যবানদের যাকাত প্রদানে নির্দেশ প্রদান করেছেন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা, ‘তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা কর, যাকাত প্রদান কর’। যাকাত– এটি একটি আরবী শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ হল পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি। এটি সম্পদকে পবিত্র করে এবং বিবিধ ক্ষতি ও কৃপণতা থেকে মানুষকে হেফাজত করে। ইসলামের মৌলিক ৫টি স্তম্ভের মধ্যে এটি পঞ্চম। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরিয়ত নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ কোরআনে বর্ণিত ৮টি খাতের কোন একটি খাত থেকে যে কোন লোক অথবা প্রত্যেককে দান করে মালিক বানিয়ে দেওয়াকে যাকাত বলা হয়। যাকাত ছাড়া আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণতা লাভ করে না। যাকাত অস্বীকারকারীরা কাফের হিসাবে পরিগণিত হবে। যাকাত ফরজ করা হয় দ্বিতীয় হিজরীতে। সূরা বাকারার ৪৩ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছেন, ‘তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা কর, যাকাত আদায় কর, যারা রুকু করে তোমরাও তাদের সাথে রুকু কর’। সূরা মায়ারেজের ২৪ ও ২৫ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘(যারা বিশ্বাস করে) তাদের সম্পদের সুনির্দিষ্ট অধিকার আছে–এমন সব লোকদের জন্য–যারা (অন্যদের কাছে কিছু) চায় এবং যারা (নানা সুবিধা) বঞ্চিত’। ৫টি স্তম্ভের মধ্যে নামাজ এবং রোজার সম্পর্ক মানুষের দৈহিক পরিশ্রম ও মনের সাথে সম্পৃক্ত। পক্ষান্তরে যাকাত ও হজ্বের সম্পর্ক অর্থের সাথে রয়েছে। বনী ইসরাঈলদের যুগে যাকাতের বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর স্মরণ করুন, আমরা যারা বনী ইসরাঈলদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিলাম এই বলে যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবে না, পিতা–মাতার সাথে সৎ ব্যবহার করবে, নামাজ কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে’। এছাড়া আল্লাহতায়ালা হযরত ঈসা (আঃ) এর উপর যাকাত ও নামাজ সম্পর্কে অসিয়ত করে বলেন, আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন নামাজ ও যাকাত সম্পর্কে–যতদিন আমি জীবিত থাকব। পরবর্তীতে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর উপর যাকাত প্রদান ফরজ করা হয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ কোরআনের সমস্ত আয়াতসমূহে দরিদ্রদের দুঃখ মোচনের আহবান জানানো হয়েছে। আর যারা যাকাত দেয় না তাদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে। তবে ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় মুসলমানদের উপর যাকাত ফরজ ছিল না। যে ব্যক্তি যাকাত বা সদকা প্রদান করত তাকে উৎসাহিত করা হত। কারণ সেই সময় যাকাত সম্পর্কিত আয়াত নাযিল হয়েছে। কিন্তু যাকাত ফরজ হওয়ার আয়াত নাজিল হয়নি। কিন্তু রাসূল (সাঃ) হিযরত করে মদিনায় চলে গেলে ইসলামের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালা সুস্পষ্ট বিধান প্রয়োগ করেন। যাকাতের ক্ষেত্রেও মদিনায় আল্লাহতায়ালা রাসূল (সাঃ) এর উপর নাযিল করেছেন। কোরআন মাজিদে মোট ১৮টি সূরার ২৯ টি আয়াতে যাকাত শব্দটি ব্যবহার দেখা যায়। তার মধ্যে ৯ টি মক্কী এবং ৯টি মাদানী। মদিনায় নাযিলকৃত আয়াতসমূহের মধ্যে সূরা আল–হজ্ব হিযরতের প্রথম বছরে নাযিল হয়–যেখানে আল্লাহতায়ালা যাকাতকে ফরজ ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন যে তাকে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা শক্তিমান, মহা পরাক্রমশালী। তারা এমন, যাদেরকে আমি জমিনে ক্ষমতা প্রদান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং সৎ কাজের আদেশ দিবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে’। আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি তাদের পরীক্ষার জন্য যাকাত প্রদানে উৎসাহিত করেছেন। ইসলাম সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। একজনের হাতে বিপুল অর্থ সম্পদ জমা হওয়াকে ইসলাম পছন্দ করে না। ইসলাম চায়–ধনী–গরিব সবাই স্বাচ্ছন্দ্য জীবন যাপন করুক–তাই দরিদ্রের প্রতি লক্ষ্য রেখেই যাকাতের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন, আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয়–আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মোহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল আর নামাজ কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে’ (বুখারী মুসলিম)। হযরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল (সাঃ) এর হাতে বায়াত গ্রহণ করি– নামাজ কায়েম করা, যাকাত আদায় করা এবং প্রত্যেক মুসলমানদের উপর কল্যাণ কামনার উপর (বুখারী মুসলিম)। হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) বর্ণনা করেন, ‘একদা রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে নসিহত করছিলেন। ৩ বার শপথ করে তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, রমজানে রোজা রাখবে, যাকাত প্রদান করবে এবং সব ধরনের কবিরা গুণাহ থেকে দূরে থাকবে আল্লাহতায়ালা তার জন্যে অবশ্যই বেহেস্তের দরজা খুলে দিয়ে বলবেন, ‘তোমরা নিরাপদে তাতে প্রবেশ কর’ (নাসাঈ ২৩৯৫)। যারা যাকাত আদায় করে না, তাদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির সংবাদ এসেছে। সূরা ইমরানের ১৮০ নাম্বার আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘আল্লাহতায়ালা নিজের অনুগ্রহ দিয়ে তাদের যে প্রাচুর্য্য দিয়েছেন যারা তা আল্লাহর পথে ব্যয় করতে কার্পণ্য করে – তারা যেন কখনো এটা মনে না করে, এটা তাদের জন্য কল্যাণকর কিছু হবে; না, এ (কৃপণতা আসলে) তাদের জন্য খুবই অকল্যাণকর; কার্পণ্য করে তারা যা জমা করেছে কেয়ামতের দিন অচিরেই তা দিয়ে তাদের গলায় বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হবে, আসমানসমূহ ও জমিনের উত্তরাধিকার আল্লাহতায়ালার জন্যেই, আর তোমরা যা কর আল্লাহতায়ালা তা সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন’। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর যুগে যাকাতের বিধান সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে পাকে বলেন, ‘আমি তাদের ইমাম/নেতা বানিয়েছি যাতে তারা তার নির্দেশনামতো আমার বিধানুযায়ী চলে এবং আমার জন্যে ভালো ভালো কাজস্বরূপ, নামাজ কায়েম ও যাকাত প্রদান করত। বস্তুত তারাই ইবাদাতকারী ছিল। হযরত ইসমাঈল (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করুন, হযরত ইসমাঈল (আঃ) এর কিতাবের কথা, নিশ্চয় তিনি ওয়াদা সত্য গ্রহণকারী ছিল এবং তিনি নবী–রাসূল। তিনি তার জনগণকে নামাজ পড়া এবং যাকাত দেওয়ার নির্দেশ দিতেন। আর তিনি আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় ও সন্তুষ্টির পাত্র ছিলেন। আল্লাহতায়ালা যাকাত অনাদায়কারীদের বিরুদ্ধে তাঁর পবিত্র কোরআনে পাকে বলেন, ‘যারা সোনা, রূপা জমা করে রাখেন এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তুমি তাদের কঠিন পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে কোন সোনা বা রূপার মালিক যদি আপন সম্পদের মালের যাকাত আদায় না করে, তার এই সম্পদকে আল্লাহতায়ালা জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করবেন–কেয়ামতের দিন তা দ্বারা পিঠ, পার্শ্ব এবং কপালে ছ্যাকা দিবেন আর যখনই তা ঠান্ডা হবে সাথে সাথে আগুনে পুনরায় উত্তপ্ত করা হবে। এমন দিনে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে যে দিনটি হবে ৫০ হাজার বছরের সমান। আর বান্দার বিচারকার্য শেষ হওয়া পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকবে। অতপর সে দেখতে পাবে তার গন্তব্য হয় জান্নাতের দিকে নয়তো জাহান্নামের দিকে (মুসলিম)।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল