শিক্ষা মন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে সাধুবাদ জানাই। পূর্ণ মন্ত্রী হয়ে তিনি গেল সপ্তাহে একটি যুগোপযোগী ও সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন যা সচারচর দেখা যায় না। বিষয়টা হলো, অফসেট প্রিন্টিং মেশিন কেনা–সংক্রান্ত কাজে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পাঁচ কর্মকর্তার ‘জাপান সফরের‘ অনুমোদন তিনি দেননি। ঢাকার সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এসএসসি ও সম–মানের পরীক্ষা উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষা মন্ত্রী এই তথ্য নিশ্চিত করেন। সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও আমরা অহরহ দেখি কী ভাবে সরকারি কর্মকর্তারা প্রয়োজনে–অপ্রয়োজনে, কোন একটা অজুহাত দেখিয়ে বিদেশ–সফর করে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করে বেড়ান। এই নিয়ে বিগত দিনে বিভিন্ন পত্র–পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। হয়েছে সমালোচনা। সরকারি নিষেধাজ্ঞাও এসেছে। এমন কী খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বছর কয়েক আগে এই নিয়ে তার বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। গত ২০১৯ সালে ‘একনেকের’ এক সভায় প্রধান মন্ত্রী পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে বাংলাদেশের নিজস্ব ভবন (দূতাবাস) নির্মাণ উপলক্ষে সরকারি কর্মকর্তাদের পাকিস্তান সফর নিয়ে যে ‘আয়োজন’, তার জন্যে সরকারি কর্মকর্তাদের ভর্ৎসনা করেছিলেন ও বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি অভিযোগ করে বলেছিলেন, ‘যে কাজটি এক বারে একই টিম দিয়ে করা সম্ভব, সেই কাজের জন্যে তিনবার তিনটি দলকে সরকারি অর্থে বিদেশ পাঠানোর কোন অর্থ থাকতে পারে না’। এটি চার বছর আগের কথা। কিন্তু এর মধ্যে পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। বরঞ্চ বেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভাবখানা এই ‘টাকা লাগে তো দেবে গৌরী সেন’। যাই হোক, পত্রিকায় প্রকাশিত উক্ত সফর সম্পর্কে জানা যায়, জাপান সফর তালিকায় ছিলেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবর খান সহ বোর্ডের বিভিন্ন পর্যায়ের পাঁচ কর্মকর্তা। ওই সব কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার অনুমোদন–সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব বোর্ডের পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিষ্টার নওফেল তাতে অনুমোদন দেননি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে সরকারিভাবে একটি নির্দেশনা আছে যে, প্রয়োজন ছাড়া যেন বিদেশে যাওয়া না হয়। ছাপাখানার যন্ত্র কেনার জন্য তাঁরা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ নন। সে জন্যই নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে প্রয়োজন হলে অবশ্যই যেতে হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে যাঁরা বিশেষজ্ঞ, কেবল তাঁরাই যাবেন– এ ধরনের একটি অবস্থান তাঁদের (মন্ত্রণালয়ের) আছে।’ ব্যারিষ্টার নওফেলকে ধন্যবাদ এই জন্য যে, তিনি চাইলে বিষয়টি তার পূর্বসূরীদের মত অনুমোদন দিতে পারতেন। কেননা অনুমোদন না দেয়া মানে কোন একটি মহলের বিরাগভাজন হওয়া। আমরা জানি উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে কতটুকু প্রভাব রাখেন। তরুণ এই মন্ত্রী তার তোয়াক্কা না করে এই অপ্রয়োজনীয় ‘আবদারের’ অনুমোদন না দিয়ে জনগণের অর্থের অপচয় রোধ করেছেন সে জন্যে ধন্যবাদার্হ। তিনি সাহস করে এই কর্মটি করেছেন। এই প্রসঙ্গে হেলাল হাফিজের সেই বিখ্যাত কবিতার কথা মনে পড়ে– ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ তরুণরাই পারে সাহসী হতে, পারে যা কিছু পুরোনো, গদবাঁধা কিংবা ‘অবসলিট’ তা ভাঙ্গতে। শিক্ষা মন্ত্রী বয়সে তরুণ। ইতিমধ্যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। তার মতো তরুণ রাজনীতিবিদদের কাছ থেকেই এমন ভালো কিছু পদক্ষেপ জাতি আশা করে।
বিগত দিনের পরিস্থিতির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, জনগণের অর্থ ব্যয়ে তথাকথিত ‘স্টাডি ট্যুরের’ নামে সরকারী কর্মচারীদের ঘনঘন বিদেশ–ভ্রমণ স্রেফ আনন্দ–ভ্রমণ ছাড়া আর কিছু নয়। এ আমার কথা নয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি পত্রিকা ‘নিউ এইজে’ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘এই ধরনের ভ্রমণ থেকে বেশির ক্ষেত্রে দেশের জন্যে সুফল বয়ে আনেনি। হয়েছে কেবল জনগণের অর্থের অপচয়’। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, যদিও বা বেশির ক্ষেত্রেই কোন পজিটিভ ফলাফল আসে না, তারপরও এই ধরনের কর্মকাণ্ড চলে আসছে বাধাহীন। নীতিনির্ধারকরা বারবার এই ধরনের ‘নিরর্থক’ কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে জনসাধারণের অর্থের অপচয়ের বিরুদ্ধে সতর্ক বার্তা দিলেও পাবলিক এজেন্সিগুলি এই ধরনের বিদেশ ভ্রমণের জন্য তহবিল বরাদ্দের বিধান সহ প্রস্তাব নিয়ে আসছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি ‘যোগসাজশ’ রয়েছে বলে উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অভিযোগ অস্বীকার করেননি পরিকল্পনা মন্ত্রীও। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন এই ধরনের তথাকথিত ট্যুর উন্নয়ন বাজেটের একটি অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় বোঝা। বিগত বছরগুলিতে এই নিয়ে অহেতুক বিদেশ সফরের বিরুদ্ধে সমালোচনা সত্ত্বেও দেখা গেছে, সরকার ২০১৮–১৯ আর্থিক বছরে এই ক্ষেত্রে ৩১২৯,৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, পরবর্তী অর্থ বছরে (২০১৯–২০) তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪০৬৪ কোটি টাকা এবং ২০২০–২১ আর্থিক সালে তা ৩৯৬০ কোটি টাকা। দেখা যায় কয়েকটি কারণে এই সমস্ত শিক্ষা ভ্রমণ অকার্যকর হয়ে পড়ে। তার অন্যতম কারণ হলো, যে সমস্ত সরকারি কর্মকর্তা ট্রেনিং, শিক্ষা বা প্রাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে বিদেশ যান, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় দেশে ফিরে আসার পর তাদের ভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বদল করা হয়েছে। ফলে দেখা যায় নতুন যে স্থানে তাকে বদলি করা হলো, সেখানকার কাজের সাথে বিদেশে অর্জিত জ্ঞানের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। তখন সেই শিক্ষা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এমনও দেখা গেছে যাকে এই প্রশিক্ষণের জন্যে বিদেশ পাঠানো হয়েছে তার ওই বিষয় সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। বছর কয়েক আগে আর এক তরুণ মন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক হল্যান্ড সফরকালে তার উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন যখন দেখা গেল তার সফর সঙ্গী হিসাবে আসা বেশির ভাগ সরকারি কর্মকর্তা যে অনুষ্ঠানের কারণে আসা সেই অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত। তারা তখন নতুন দেশ দেখা ও শপিং নিয়ে ব্যস্ত। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটির মতে, জ্ঞান অর্জন ও দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের এই ধরনের বিদেশ সফরের উদ্দেশ্য। কিন্তু বেশির ক্ষেত্রে এই সফর, স্রেফ আনন্দ ভ্রমণ ও শপিং ট্যুরে পরিণত হয়। তারপরও দেখা গেছে সরকার বছরের পর বছর এই ধরণের ভ্রমণের অনুমতি দিয়ে চলেছে। বিদেশ সফরের প্রয়োজন রয়েছে তাতে কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু কাদের বিদেশ পাঠানো হচ্ছে তাদের যোগ্যতা এবং পাঠানো সরকারি কর্মকর্তার সংখ্যা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। যেমন দেখা যায়, কীভাবে একটি সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ‘পুকুর’ খনন করতে হবে, তা জানার জন্যে ২০১৯ সালে হল্যান্ড, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ায় দুই ডজন কর্মকর্তাকে বিদেশ পাঠানোর প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হলে এর কিছু অনুমোদন করা হয় এবং কিছু প্রস্তাব সংশোধনের জন্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়। সুখের বিষয় সরকার ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বিরাজমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ২০২৩–২৪ অর্থ বছরে অপারেশন ও উন্নয়ন বাজেট সহ বিদেশ–ভ্রমণ ও বিদেশে কর্মশালা বা সেমিনারে অংশগ্রহণ সীমাবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক বিজ্ঞপ্তিতে সরকার এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বলে, তবে কিছু প্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি দেয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে স্কলারশিপ বা ফেলোশিপের অধীনে বিদেশি সোর্স দ্বারা অর্থায়নকৃত মাস্টার্স এবং পিএইচডি শিক্ষা। বিদেশি সরকার, কোন সংস্থা দ্বারা সম্পূর্ণ অর্থায়নে প্রশিক্ষণের জন্যও কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হবে। এতে আরো জানানো হয়, সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এই ধরনের সফরে অর্থায়ন করলে তারা পণ্য পরিদর্শনের জন্য বিদেশেও যেতে পারবেন। এখন দেখার বিষয় বাস্তবে এর কতটুকু প্রতিফলন ঘটে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : শিক্ষা মন্ত্রী ব্যারিষ্টার নওফেল আমাদের গৌরব। তিনি চট্টগ্রামের সন্তান। চট্টগ্রামের ভূতপূর্ব মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর সন্তান। তিনি নিঃসন্দেহে তার যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান। বর্তমানে দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে বেহাল দশা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার পরিবেশ কতটুকু বিরাজমান তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। দিন কয়েক আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় আক্ষরিক অর্থে রণক্ষেত্রে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ, দুর্নীতির কারণে ভিসির পদত্যাগ দাবি এ যেন নিত্যদিনের ব্যাপার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্র বিধায় এই সমস্ত ঘটনা দেখে–শুনে কষ্ট হয়। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন প্রথম ভিসি আজিজুর রহমান মল্লিক থেকে শুরু করে ড. ইন্নাস আলী, সাহিত্যিক আবুল ফজল, অধ্যাপক আব্দুল করিম, অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী প্রমুখর মত বিজ্ঞ শিক্ষাবিদরা। তাদের সময়ে ইদানিংকার এই অনিয়ম, দুর্নীতির কথা কখনো শুনিনি। তাদের বিরুদ্ধে ছাত্রদের কোনদিন কোন অভিযোগ ছিল না, ছিল না তাদের পদত্যাগের দাবি। ছিল না কারণ, স্রেফ রাজনৈতিক ‘কানেকশনের’ কারণে তাদের নিয়োগ হয়নি বিধায়। বর্তমানে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে অবক্ষয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তার বাইরে নয়। শিক্ষা মন্ত্রী এই অবক্ষয় সম্পূর্ণ দূর করতে হয়তো পারবেন না, কিন্তু শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে পারবেন বলে আশা করি। ছাত্র রাজনীতি এখন আর গঠনমূলক রাজনীতিতে নেই। তা হয়েছে পেশী শক্তি প্রদর্শনের উর্বর ক্ষেত্র। আশা করবো শিক্ষা মন্ত্রী এই দিকটায়ও মনোযোগ দেবেন এবং সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম হবেন। লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট