পেটে ডিম নিয়ে কক্সবাজার সৈকতে গতকাল শুক্রবার একদিনে ভেসে এলো আরও ২৪টি স্ত্রী কাছিমের মৃতদেহ। এনিয়ে টানা ১০ দিনে ৬৬টি অলিভ রিডলি বা জলপাই রঙা প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ ছাড়াও ৩টি ডলফিন ও পরপইসসহ চারটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। আর এভাবে সাগরের বিপন্ন প্রাণীগুলোর মৃত্যুর ঘটনা অস্বাভাবিক ও নজিরবিহীন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সমুদ্রবিজ্ঞানীরা জানান, প্রতিবছর নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রজনন মৌসুমে শত শত অলিভ রিডলি বা জলপাই রঙা প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ একযোগে কক্সবাজার সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ডিম পাড়তে আসে। চলতি মৌসুমের সর্বশেষ ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭৬টি অলিভ রিডলি কচ্ছপ ৯ হাজার ১০৭টি ডিম পেড়েছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি একদিনে সর্বোচ্চ ৮টি কচ্ছপ ডিম পাড়ে। আর চলতি মৌসুমে সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ৯১টি কাছিমের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। যার মধ্যে ৬৬টি মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে গত ১০ দিনে। আর এ ঘটনা অস্বাভাবিক ও নজিরবিহীন বলে মনে করেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বোরি) সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে বোরি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আমি সমুদ্র সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছি। কিন্তু এই ধরনের ধারাবাহিক সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনা কখনও দেখিনি এবং এখনও পর্যন্ত কারো কাছ থেকে শুনিনি।
কিন্তু হঠাৎ করে বঙ্গোপসাগরের বাস্তুতন্ত্রে এমন কী ভয়ংকর আগ্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে, যার ফলে সাগরের মতো একটি লার্জ মেরিন ইকোসিস্টেমস প্রভাবিত হতে পারে? এর জবাব পাওয়া যায়নি সরকারি–বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে। দেশের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে এসব সামুদ্রিক প্রাণী দেখভালের দায়িত্ব বনবিভাগের। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয় হতে বনবিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগে পাঠানো এক প্রতিবেদনে সৈকতে ভেসে আসা প্রাণীগুলো জেলেদের জালে আটকা পড়ে অথবা গভীর সমুদ্রে বড় নৌযানে ধাক্কা খেয়ে মারা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্ত্রী কাছিম কক্সবাজার সৈকতে ডিম পাড়তে আসার পথে সাগরে ট্রলার বা জাহাজের ধাক্কায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে, নিষিদ্ধ কারেন্ট ও টানা জালে আটকা পড়ে, জেলেদের জালে আটকা পড়ার পর মেরে ফেলার কারণে এবং সৈকতে কুকুর ও শিয়ালের কামড়ের কারণে মারা যেতে পারে।
আইনে সামুদ্রিক প্রাণীর দেখভালের দায়িত্ব বনবিভাগে ন্যস্ত থাকলেও এ নিয়ে গভীর সাগরে কাজ করার সক্ষমতা তাদের নেই বলে জানান কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা ইসরাত ফাতেমা। কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সারওয়ার আলম জানান, সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করার মতো দক্ষ জনবল তাদের নেই। তিনি বলেন, এ বিষয়ে বোরি কাজ করছে।
বোরির মহাপরিচালক প্রফেসর ড. তৌহিদা রশিদ বলেন, সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যুর কারণ জানার জন্য ফরেনসিক নমুনা পরীক্ষার সুযোগ বাংলাদেশে নেই। তাই এ বিষয়ে মৃত প্রাণীর বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য দেখে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে ধারণা পাবার চেষ্টা করেন বিজ্ঞানীরা। তিনি বলেন, সমপ্রতি ব্যাপকভাবে সামুদ্রিক প্রাণীর মৃতদেহ ভেসে আসার পর একটি কুইক রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে। এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের জন্য খুব শীঘ্রই অংশীজনদের নিয়ে একটি সভা ডাকা হবে।
সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে বনবিভাগ ছাড়াও নানাভাবে কাজ করছে মৎস্য অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ আরও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা। তবে সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণে সচেনতামূলক কার্যক্রম চালানো ছাড়া তাদের কোনো কার্যক্রম সম্পর্কে জানা যায়নি। ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডাব্লিউসিএস) কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. জাহাঙ্গীর আলম জানান, তাদের সংস্থার সর্বশেষ জরিপে বঙ্গোপসাগরে মোট ১৩ জাতের সিটাসিয়ান বা সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে ৮ প্রজাতির ১৬ হাজার ডলফিন, ৪ প্রজাতির তিমি ও মাত্র এক প্রজাতির পরপইস রয়েছে।
একটি স্বাস্থ্যকর সমুদ্রের প্রয়োজনীয় অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত সি–টার্টল বা সামুদ্রিক কচ্ছপ। সমুদ্রের পচা–গলা বস্তু খেয়ে এরা দূষণ পরিষ্কার করে। বিশ্বে সাত প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে তিন থেকে পাঁচ প্রজাতির কচ্ছপের দেখা মেলে। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশই অলিভ রিডলি। এছাড়া গ্রিন টার্টল বা সবুজরঙা কচ্ছপ ও হক্সবিল বা ভূত কচ্ছপও মাঝেমধ্যে দেখা যায়। আর সাগরে ডলফিন, পরপইস ও তিমিসহ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিশাল পরিবেশগত সেবার কারণে এদেরকে ইকোসিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ার বা বাস্তুসংস্থান প্রকৌশলী বলা হয়। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে বাংলাদেশে সামুদ্রিক কচ্ছপ, স্তন্যপায়ী প্রাণী ডলফিন ও পরপইস সংরক্ষিত প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত। এগুলো শিকার করা, খাওয়া, অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ পরিবহন ও ক্রয়–বিক্রয় করা দণ্ডনীয় অপরাধ।