১৯৭৪ সালে চীনের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট দেং জিয়াও পিং স্ব নিয়ন্ত্রিত আইসোলেশন ভেঙে যখন আমেরিকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন প্রেসিডেন্টের বিমান ভাড়ার জন্য চীনের সবগুলো ব্যাংক মিলে মাত্র ৩০,০০০ ডলার যোগাড় করতে পেরেছিলো। তখন অনেকে ভেবেছিলো যে রাষ্ট্র তার প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রীয় সফরের বিমান ভাড়া যোগাড় করতে পারে না, সে রাষ্ট্র কিভাবে অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করবে। যদি তখন চীন সমাজতাত্ত্বিক সমাজ ব্যবস্থা বা দর্শনের উপর পুঁজিবাদকে নতুন করে বিন্যাস না করতো, তাহলে তারা বর্তমানের এই অবস্থানে আসতে পারতো না। তখন চীন গুটিকয়েক ফিনিসড প্রোডাক্ট ছাড়া তাঁদের প্রাকৃতিক উপায়ে প্রাপ্ত যৎসামান্য কাঁচামাল রপ্তানি করতো। তাদের ছিলো পুঁজির চরম সংকট। এরপর তারা বিশ্বের আনাচে কানাচে পুঁজি সংগ্রহের জন্য হন্য হয়ে মনোনিবেশ করে এবং তাতে তারা সফল হয়। চীন যখন ডব্লিউ টি ওতে সাইন করে তখন পশ্চিমাদের ধারনা ছিলো, চীনের বিশাল বাজার তারা দখল করতে পারবে। কিন্তু ঘটলো অন্য রকম ঘটনা। চীন যে ভিতরে ভিতরে এত প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে সেটি পশ্চিমাদের কল্পনার বাইরে ছিলো। এখন পশ্চিমের পুরো বাজার চীনের দখলে। পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকানরা চীনকে গালাগালি করলেও তাদের কারখানা কিন্তু চীনে। সামাজিক নিরাপত্তা, সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, গুড গভর্নেন্স, শ্রমিকের স্কীল, কম পারিশ্রমিক অর্থাৎ কম পুঁজি ও খরচে পণ্য তৈরি করতে পারা–চীনের উত্থানের মূল রহস্য। বর্তমানে চীনের সাথে আমেরিকার সংঘাতের মূল জায়গা হলো চীন পুঁজিকে ধারণ করে এমন শক্তিশালী হয়েছে যে, তারা এখন আলপিন থেকে শুরু করে নভোযান পর্যন্ত সবকিছু তৈরি করতে পারে। এখন চীন আমেরিকাকে ট্রিলিয়ন ডলার ধার দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিছু দিন আগে তারা বাংলাদেশকে রিজার্ভ সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। বর্তমানে চীন বিশ্বে বেশিরভাগ ফিনিসড প্রোডাক্ট রপ্তানি করে, যা ৪০–৫০ বছর আগে কল্পনাও করা যেতো না। এখন কোনও কারণে যদি চীন ফিনিসড প্রোডাক্ট উৎপাদন বন্ধ করে দেয়, তবে পুরো বিশ্বে চরম বিপর্যয় নেমে আসবে।
আরেকটি সমাজতাত্ত্বিক দেশ ভিয়েতনাম যেটিকে আমেরিকা নাপাম বোমার আঘাতে তামা করে দিয়েছিলো। তারাও বাজার অর্থনীতি ধারণ করে বড় বিনিয়োগের জায়গা হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, যে আমেরিকা বোমা ফেলে ভিয়েতনামকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলো, আজ সেই আমেরিকাই ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় পার্টনার ও বিনিয়োগকারী।
তালেবান শাসিত আফগানিস্তান, যে দেশকে আমেরিকা ও রাশিয়া যুগ যুগ ধরে আক্রমণ ও পছন্দের পুতুল সরকার বসিয়ে নিজেদের কব্জায় রাখতে চেয়েছিলো সেই আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক ও উৎপাদিত পণ্য বিশেষ করে ফল ও ফলের তৈরী পানীয় (পামির কোলা) আজ ইউরোপ আমেরিকার বাজার দখল করে নিয়েছে। অথচ পশ্চিমা বিশ্বের ধারণা ছিলো মোল্লাদের (তালেবান) শাসিত আফগানিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
উল্লিখিত দেশগুলোর উত্থানের মূল কারণ হলো তারা তাদের প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত কাঁচামালকে যথাযথভাবে ফিনিসড প্রোডাক্টে পরিণত করার সিদ্ধান্ত দৃঢ়তার সাথে বাস্তবায়ন করেছে। ফলশ্রুতিতে তারা তাদের নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে এবং ভবিষ্যতে তারা আরো উন্নতি করবে–এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়। বাংলাদেশও প্রাকৃতিকভাবে বেশ কিছু কাঁচামাল পেয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও এসব কাঁচামালকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে আমরা ফিনিসড প্রোডাক্টে পরিনত করতে পারিনি। একসময় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানী পণ্য ছিলো পাট, চামড়া ও চা। এখনো দেশে প্রচুর পাট, চামড়া ও চা উৎপন্ন হয়। অথচ পাট ও চামড়াকে আজো আমরা ফিনিসড প্রোডাক্ট বা বহুমুখীকরণ করে নিজস্ব ব্রান্ড তৈরি করতে পারিনি। বিষয়টি সত্যি দুঃখজনক। কয়েকদিন আগে আমি বিশ্বের কয়েকটি বড় বড় ব্যান্ডসপে গিয়ে দেখেছি, ওখানে রক্ষিত সব চামড়া ও পাট জাত পণ্য চায়নার তৈরি। এখনো বিশ্বের সেরা মানের পাট আমাদের দেশে উৎপন্ন হয়। অথচ আমাদের দেশের পাটকলগুলোকে লোকসানের অজুহাতে আমরা বন্ধ করে রেখেছি।
আর চামড়ার ইতিহাস আরো বেশি করুণ। প্রতি বছর কোরবানের সময় শত শত চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলি। কিন্তু কেন? কেন আমরা চামড়ার সঠিক দাম পাই না? এর উত্তর হলো–শুধুমাত্র কমপ্লায়েন্সের (দূষণমুক্ত ও উন্নত কর্মপরিবেশ) অভাবে বিশ্ব বাজারে আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য কেউ কিনতে চায় না। অথচ একটি বিষয়ের জন্য চামড়া শিল্পের এই দুর্দশা, সেটি হলো ইটিপি। যার মাধ্যমে চামড়া প্রসেসিং এর সময় নির্গত বর্জ্য যথাযথ ভাবে দূষণমুক্ত করা হয়। গত ৫২ বছরে চামড়া নগরীতে বা শিল্পে মানসম্পন্ন ইটিপি তৈরি করতে না পারা সত্যিই দুঃখজনক। সেজন্য হাতে গোনা মাত্র চারটি কারখানা বর্তমানে এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত এবং সব কটি সাভারের চামড়াশিল্প নগরীর বাইরে। আশ্চর্যের বিষয় হলো শুধু এলডব্লিউজি সনদের অভাবে দেশে চামড়া শিল্পের যথাযথ বিকাশ হচ্ছে না ও বিশ্বের বড় বড় ব্যান্ডগুলোর সাথে আমরা যুক্ত হতে পারছি না। অথচ দেশে পণ্য রপ্তানি বহুমুখী করণের ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় খাতগুলোর মধ্যে চামড়াশিল্প অন্যতম। স্থানীয়ভাবে মানসম্মত চামড়ার পর্যাপ্ত জোগান সত্ত্বেও এই শিল্পের রপ্তানি আশানুরূপ নয়।
তবে সমপ্রতি বিসিকের এক গবেষণায় কমপ্লায়েন্স অর্জন না হওয়ার পেছনে চারটি কারণের কথা উঠে এসেছে। কারণগুলো হলো সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) সক্ষমতার অভাব, কমপ্লায়েন্স সম্পর্কে কারখানা বা ট্যানারি মালিকদের যথাযথ ধারণা না থাকা, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা এবং ট্যানারির অভ্যন্তরীণ পরিবেশের মান উন্নত না হওয়া। এসব কারণে ট্যানারি শিল্পের মান সনদ প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) থেকে স্বীকৃতি পাচ্ছে না সাভারে অবস্থিত ট্যানারিগুলো।
মূলত চামড়াশিল্পে কমপ্লায়েন্স অর্জনের ক্ষেত্রে ট্যানারিগুলোর দুর্বলতা কোথায়, তা জানতে বিসিকের গবেষণাটি করা হয়। তবে এতে সিইটিপির দুর্বলতা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়নি। বর্তমানে সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে চালু ১৪০টি ট্যানারির মধ্যে ১০৯টি ট্যানারির তথ্য নিয়ে গবেষণাটি করেছে বিসিক। প্রতিবেদনে বলা হয়, এলডব্লিউজি সনদ পেতে হলে ট্যানারিগুলোকে বেশ কিছু মানদণ্ড পূরণ করতে হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো ট্যানারির সামাজিক নিরীক্ষা। কিন্তু চামড়াশিল্প নগরীর প্রায় ৮৫% ট্যানারি এই নিরীক্ষা সম্পন্ন করে না। চামড়া উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অন্যতম ক্ষতিকর পদার্থ ক্রোমিয়াম। শিল্পনগরীর অর্ধেক ট্যানারিই তাদের কারখানায় ব্যবহৃত ক্রোমিয়ামের মাত্রা পরিমাপ করে না। আর ৭০% ট্যানারি কারখানায় ব্যবহৃত ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থ ও বর্জ্যের তালিকা (রেজিস্টার) সংরক্ষণ করে না। বিসিকের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, সাভারের ট্যানারিগুলোর মধ্যে ৩৫টির পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই, বয়লারের অনুমতি নেই ২০টির এবং রাসায়নিক পদার্থ ক্রয় ও সংরক্ষণের অনুমতি নেই ৩৬টির। শিল্পনগরীর ৮৬% ট্যানারির ইনকামিং ট্রেসিবিলিটি ও ৫৫% ট্যানারির আউটগোয়িং ট্রেসিবিলিটি নেই। অর্থাৎ কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্যের গন্তব্য তাদের জানা নেই। অন্যদিকে ট্যানারির মালিকদের অভিমত, কমপ্লায়েন্স অর্জনের ক্ষেত্রে সিইটিপিই প্রধান বিষয়। সেটি ঠিক না করে ট্যানারিগুলোর মান নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে বিসিক দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে।
এভাবে যুগের পর যুগ ধরে একে অপরের মধ্যে কাঁদা ছোড়াছুড়ি ও দোষারোপের মধ্যমে এগিয়ে চলছে আমাদের চামড়া শিল্প। কিন্তু সমাধানের জন্য সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসছে না কেউ। যা সত্যি দুঃখজনক ও লজ্জার।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।