মানব প্রকৃতির সহজাত বৈশিষ্ট্যই হলো চিন্তার নিরন্তর প্রবাহকে অব্যাহত রাখা। নদীর স্রোতের স্বাভাবিক গতি প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করলে তা যেমন দুকূলপ্লাবী হয়ে উঠে প্রকৃতি ও জীবনের স্বাভাবিকতাকে ম্লান করে দেয় তেমনি চেতনার নির্ঝরের স্লোতধারার প্রবাহ রুদ্ধ হলেই তা ভিন্ন রূপে ভিন্ন আঙ্গিঁকে বাধা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে প্রকৃত সত্য ও তথ্যকে সভ্যতার সোপানতলে প্রতিষ্ঠিত করবেই। ইতিহাসে বার বার দেখা যায় পরাক্রান্ত বিশ্বাসের বা text এর পরিবর্তনহীনতার আপাত বিশ্বাস তাসের ঘরের মতই ভেঙ্গেঁ পড়ে। যারা তা যত আগে উপলব্ধি করতে পারেন আপন বোধ ও বিবেচনায় তারা পরিবর্তনকেই সত্য মেনে ভিন্ন স্বরের অনিবার্যতাকে স্বীকার করে নেন। সেমেটিক খৃষ্টীয় বিশ্বাসের বিশ্বছবির অ্যারিষ্টটল থেকে টলেমি পর্যন্ত, চলে আসা একক স্বরকে কোর্পানিকাস, গ্যালিলিও বিশ্বাসী হয়েও সত্য স্বর প্রকাশের নৈতিক তাড়নায় অত্যাচারিত হয়েও অর্থোডক্স চার্চের প্রবল প্রভাবের মুখে অস্বীকার করলেন। জীবনের অভিজ্ঞতা চিন্তা ও স্বরের নবতর আবির্ভাবকে, রেনেসাঁকে আত্মস্ত করে আটলান্টিকের উভয় পাড় শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বহুত্ববাদী হইজাগতিকতার উদার রাজনৈতিক আবহের উন্মুক্ত প্রান্তর হিসাবে বিশ্বাসী–অবিশ্বাসী নির্বিশেষে নানা স্বর ও মতের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে গড়ে উঠে বিশ্বমঞ্চে দখল করে নিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের আসন। উপনিষদ বলছে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’,সমস্ত বসুধা, সব মানুষ আত্মার আত্মীয়, অমৃতের সন্তান। এ তো ধর্মান্ধ মোদী–যোগী–অমিতের আরাধ্য আজকের বিভক্ত, বিদ্বিষ্ট ভারত নিয়ে বলা যাবে না – যেখানে ভিন্ন ধর্ম মত, বিকল্প স্বরকে দেশদ্রোহিতার নামে দেগে দেয়া হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর ভারতে পৌরানিক বিশ্বাসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠার উন্মত্ত মদমত্ততায় রাম মন্দির উদ্ধোধনের ঘটা যেন চিরন্তন ভারত আত্মার বাণীকে টুটি টিপে মারার এক রাজসূয় যজ্ঞ। হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মের উৎপত্তিস্থল ভারতকে একরৈখিক শাস্ত্রীয় মনোলিথিসিজমের অবৈজ্ঞানিক ধারনার উল্টোস্রোতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, বেকারত্ব, ক্ষুধা প্রপীড়িত অসহায় কিন্তু আজন্ম লালিত ঐশী বিশ্বাসে আস্থাশীল কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাস হৃদয়ানুভুতিকে পুঁজি করে, তাদের মোহগ্রস্ত করে নির্মমভাবে ঠকানোর জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে একটি চাকচিক্যময় কাঠামো নির্মাণ করে মধ্যযুগীয় উন্মাদনায় আজ পুরো ভারতের দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস চেতনায় এ পর্যন্ত অর্জিত অগ্রগতিকে অর্থহীন করে দেয়ার সংঘ পরিবারের চক্রান্ত পুরোদমে চলছে। লুটেরা করপোরেট হাউসের মালিক আদানি, আমবানি, আর তাদের আর্থ–রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের আগ্রাসী প্রতিনিধি রুচি বিহর্গিত ধর্মব্যাপারী মোদি–অমিত–যোগীদের অপপ্রয়াস পুরো উপমহাদেশের কোটি মানুষের মনোজগতকে মারাত্মক এক অধ:পতিত অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের কথায় প্রত্যেক ধর্মের স্বঘোষিত সেবকদের জন্যে বলা যায়
“মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে”
বাংলাদেশের সমাজ জীবনে ’৭৫ পরবতী সময়ে রাষ্ট্রীয় ভাবে লালিত ও প্রতিষ্ঠিত ধর্মান্ধ জীবন ভাবনা, জীবনাচরণ ও অপসংস্কৃতি আজ পূর্ণ মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত। এ ভাবে দেশে দেশে কুশিক্ষা, বিভেদাত্মক নিজ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বোধে বুঁদ হয়ে থাকা মানুষের সামনে লুট হয়ে যাচ্ছে তাদের সহায় সম্পদ। এরি অনুষঙ্গ হিসাবে দূর্বল হয়ে পড়ছে উন্নত পরার্থপর সংস্কৃতি ও জীবনবোধ। আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদী সংকীর্ণতা গ্রাস করে নিচ্ছে মানুষের শ্রেয়োবোধ। বস্তুত ১৯৮০’র দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিদানে সূচিত এই উপমহাদেশের সব দেশে চালু নিকৃষ্টতম রাজনৈতিক অর্থনীতি তথা “ক্রোনি ক্যাপিটেলিজমের” বা স্বজন তোষণ মূলক অর্থনীতির বিষময় ফল এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে তীব্রতর হয়ে উঠেছে সমাজে, রাজনীতিতে ও অর্থনীতিতে। স্বাভাবিকভাবে এর প্রভাবে এখানে ভিন্নস্বর অবদমিত ও অবাঞ্চিত। শুধু নির্বাচনে অপরাজিত থাকার জন্য ইতিহাসে অনুপলব্ধ হাজার হাজার বছর পূর্বে রচিত এক মহাকাব্যের কাল্পনিক “পুরুষোত্তম”কে নিয়ে চলছে অভাবিত মাতামাতি। এর বিপরীতে বিকল্প ইতিহাস ভাবনা নিয়ে ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারছেনা। রাজনীতির প্রতিক্রিয়াশীলতা হিন্দু ধর্মের এক সময়ের সহনশীল উদারতা গ্রাস করে নিয়েছে। মেঘনাদকে পেছন থেকে হত্যা করার লক্ষণের ভ্রাতৃজ্ঞা পালনের নির্মমতার কথা ২০০ বছর পূর্বে কবি মধূসূদনই তুলে ধরেছেন বিখ্যাত “মেঘনাদবধ কাব্যে” মিল্টনীয় দ্রোহের ধারার। কিন্তু আজকের অসহিষ্ণু ধর্ম ব্যাপারীরা ভিন্ন স্বর মানে না। এই শাসক গোষ্ঠী সবদেশেই বিকল্প স্বরকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য ধর্মের নামে মানব সভ্যতার পরতে পরতে সংঘটিত হত্যা, ধ্বংস, বৈষম্য ও নির্মমতাকে আড়াল করে ইহজাগতিক আবহে বাস্তবের যাপিত জীবনকে গৌণ করে পারলৌকিক মুক্তির লোভে মানুষকে নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বোধে বিভক্ত রেখে ঘৃণার বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। ধর্ম ও রাজনীতিকে মধ্যযুগীয় কায়দার এক ও অভিন্ন করে দেখাতে চাইছে দেশে দেশে ধর্মাশ্রিত রাজনীতির মোড়লরা। বাংলাদেশে ও পাকিস্তানে ইসলাম রক্ষার নামে, ভারতে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার নামে। এমনকি কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগের মত একসময়ের উদার মধ্যপন্থীদলগুলো ক্রমে ধর্মান্ধ রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়ছে বিকৃত সমাজ মানসের চাপে, ভোটের রাজনীতির সমীকরণে। যতই প্রভাবশালী হোক শাসক গোষ্ঠীর স্বরের বিপরীতে কল্যাণকামী ও সুস্থ স্বরের উপস্থিতি যে কোন দেশের অগ্রগতির ও গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য শর্ত।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের প্রভাব আমরা প্রত্যক্ষ করছি। সর্বত্র বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। তা অন্য দিকে সংশ্লিষ্ট দেশের শাসক গোষ্ঠীর বাইরে বিকল্প সামাজিক ক্ষমতা (hegemony) ও শক্তি হিসাবে প্রভাবশালী ধর্মান্ধ রক্ষণশীলরা আরো প্রকাশ্যে ধমীর্য় বিপন্নতার ধুয়া তুলে হিংসার বাতাবরণ তৈরি করছে শুধু মুক্ত চিন্তার প্রবাহকে রুদ্ধ করে দিতে। আমাদের দেশে পাকিস্তান আমলে সমাজ যতটুকু উদার ছিল তার চাইতে আজ সমাজ রক্ষণশীলতার আব্রুতে অনেক বেশি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত ধর্মান্ধতার দীর্ঘ ছায়া আজ ছড়িয়ে পড়েছে সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রাসাদোপম অট্রালিকা থেকে বস্তির পর্ণকুটির পর্যন্ত, গ্রামের সাধারণ মাদ্রাসা থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নর্থ–সাউথ, ব্র্যাক–বিশ্ববিদ্যালয়ের মত উচ্চশিক্ষার পাদপীঠে। এ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী–শিক্ষক religiosity জ্ঞান চর্চার ভিত্তি বলছেন। তৃতীয় লিঙ্গঁ বা ট্রান্সজেন্ডার তো একধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধিতা। এ তো মাতৃজঠরে শিশুর বিকাশের ত্রুটিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এ বিজ্ঞানসম্মত বোধকে না মানার কথা বলে সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষক প্রকাশ্যে এনসিটিবির বই ছিঁড়ে ফেলে ধর্মান্ধতাকে উস্কে দিলেন কাজী আবদুল ওদুদ ও কাজী মোতাহের হোসেন প্রমুখের নেতৃত্বে পরিচালিত ১৯২৬ সালে ঢাকার তরুণ মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের বাণী– “জ্ঞান যেখানে রুদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব”। কিছুদিন পর হয়তো দাবী উঠবে বেগম রোকেয়ার “অবরোধবাসীনি” বা “সুলতানার স্বপ্ন” নিষিদ্ধ করার। প্রায় একশ বছর পরে আমরা আজ কতই না পিছিয়ে পড়েছি চিন্তায়–মননে। এ তো গেল ভাবাদর্শিক ও সামাজিক বিরুদ্ধ স্বর ও ভিন্ন মতের কথা। কিন্তু সব কিছুই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিপূরক হিসাবে ঘটে থাকে। ঐ যে গণতন্ত্রের নামে ভিন্ন স্বর, ভিন্ন মত বন্ধ করে দেওয়ার যে আয়োজন প্রগতির নামে, মুক্তিযুদ্ধের নামে চলেছে তা কি পরোক্ষভাবে প্রকৃত অগণতান্ত্রিক ধর্মান্ধতাকে পরিপুষ্ট করছেনা ? ক্ষমতাসীল দল ও শক্তি ভাবদর্শিক দিক থেকে আজ না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থায়। বরং গত ১৫ বছর ধরে অনুসৃত রাজনীতি ও অর্থনীতি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির অবস্থানকে ক্রমে শক্তিশালী করছে। মনে রাখতে হবে প্রকৃতিতে কিছুই স্থির ও স্থায়ী নয়।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন মানুষের মৌলিক প্রয়োজন শিক্ষা, অন্ন, বাসস্থান, বিনামূল্যে নিশ্চিত করে, ৭০ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খবরদারি চ্যালেঞ্জ করে, সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর মুক্তি সংগ্রামকে সার্বিক সহযোগিতা করে, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে একটি পরাশক্তি হয়েও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল কল্যাণমুখী ভিন্ন স্বরকে অবদমিত করার একদলীয় কঠিন শাসনের স্বাভাবিকতায় সৃষ্ট কিছু ব্যক্তির সদিচ্ছাপূর্ণ একনায়কত্ব। এ নিয়ে সমাজ বিজ্ঞানীরা বিশ্বব্যাপী গবেষণা করছেন। আজ তার চাইতে অনেক দূর্বল, অগুছালো আমাদের দেশের শাসক দলের অনুসৃত রাজনীতি, দূর্বৃত্তায়িত অর্থনীতির বিপরীতে প্রগতিশীল বাম গনতান্ত্রিক শক্তিকে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবীদের ভিন্নস্বর ও সুপারিশ শুধু সরকার বিরোধিতার তকমা লাগিয়ে একটি সুস্থ দেশপ্রেমিক বিকল্প স্বরের বিকাশ রুদ্ধ করে দেশকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। পরিণামে শূন্য স্থানে অতীতের মতো আগ্রাসী এক ধর্মান্ধ শক্তি এসে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, সংবিধান সবকিছু তছনছ করে দেশটিকে একটি থিওক্র্যাটিক রাষ্ট্রে পরিণত করবে। এ প্রসঙ্গে মননশীল লেখক আহম্মদ ছফার “যদ্যপি আমার গুরু” বইতে উল্লিখিত একটি ঘটনা মনে পড়ে। সেই ‘৭২ সালে একদিন জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুল রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন “আপনার অপজিশন কৈ ?” জবাবে বঙ্গবন্ধু সহাস্যে বলেছিলেন “আসন্ন নির্বাচনে কোন দল তো ৫টি আসনও পাবেনা। অপজিশন কি করে হবে।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনের প্রবীণতম, সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শিক্ষক তাঁর ছাত্র বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন “অপজিশন তো আপনিই গড়ে তুলবেন” সেদিন আত্মপ্রত্যয়ী বঙ্গবন্ধু হয়তো অধ্যাপক রাজ্জাক সাহেবের বক্তব্যের তাৎপর্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন নি। পরবর্তী ইতিহাস সর্বজনবিদিত। সেদিন অপজিশনের শূন্যস্থান পূরণ করল মোস্তাক–জিয়া। আজকের সংসদে, রাজনীতিতে, সমাজে মানুষের পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শপুষ্ট ভিন্ন স্বরের অনুপস্থিতি সামুহিক বিপদের কারণ হতে বাধ্য ইতিহাসের অনিবার্য স্রোতধারায়।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট