(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
একটি বেঞ্চের উপর বসে বিপরীত পাশের পাহাড়ের দিকে তাকিয়েছিলাম। সাগরের পাড়েই মাঝারী আকৃতির পাহাড়। গাছ–গাছালীতে ভরা। সাগরের নোনতা হাওয়া গায়ে আদর বুলিয়ে যাচ্ছিল। গাছে গাছে পাখীর কলকাকলী স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলো বালক বেলার কথা। আহা, একসময় আমাদের দেশেও কত পাখি ছিল! হংকংয়ের বাটার ফ্লাই পার্কে প্রজাপতির তেমন দেখা না মিললেও প্রচুর পাখি দেখলাম। নানা রঙের নানা জাতের পাখি। এরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
সাগরের বিচ আমাদের মতো নয়, পাথুরে বাঁধের পাশেই পানি। সাগরের তেমন তোড়জোড় দেখা গেলো না, ঢেউও নেই। একেবারে শান্ত। অদূরে সারি সারি অনেকগুলো জাহাজ নোঙর করে রয়েছে। মাঝেমধ্যে জাহাজের সাইরেনও শোনা যাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারলাম যে, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বন্দরগুলোর একটি হংকং বন্দর। এখান থেকে বেশ কাছে। কত শত জাহাজ যে এই বন্দর হ্যান্ডলিং করে। কত শত দেশের জাহাজ যে এই বন্দরে নোঙর করে, এখান থেকে যাত্রা করে! ছোট্ট দেশটি বন্দরের উপর ভর করে বিশ্বের অর্থনীতির অনেকটা নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে।
মনে মনে বন্দরটি দেখার আশা রেখে বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালাম। ড্রাইভারকে বললাম, চীন সাগরের পানি না ছুঁয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই জুতা খুলে সিঁড়ি ধরে নামতে লাগলাম। ছোট্ট বিচটিতে নামার জন্য একাধিক সিঁড়ি করে রাখা হয়েছে। পাকা সিঁড়ি। রেলিংও আছে। কয়েক ধাপের সিঁড়ি ধরে নিচে নামতে বালুতে পা ডুবে গেলো। মরুভূমির মতো বালু। পানির এতো কাছে এমন মরু!! বিষয়টি নতুন নয়, দুনিয়ার সব বিচের চিত্রই একই। পানির সাথে খেলা করে মরুর মতো বালু। অথচ সামান্য এগুলেই প্রকৃতি ফুলে ফলে ভরে থাকে, যেমনটি এখানেও ভরে রয়েছে। কী সুন্দর পাহাড়, কী সুন্দর গাছ–গাছালী! প্রকৃতি কী খেয়ালে যে পানির সাথে বালুর এমন সখ্যতা গড়ায় কে জানে! বিষয়টি সবসময়ই আমাকে ভাবায়, কিন্তু কিচ্ছু মাথায় ঢুকে না, কোন কুল কিনারা পাইনা।
বালুর উপর দিয়ে হাঁটছিলাম। ক্ষণে ক্ষণে পানিতে পাও ডোবাচ্ছিলাম। ঠনঠনে বালু, কাদার চিহ্ন নেই। আরো কিছু মানুষ বেড়াতে এসেছে। বেশ কয়েক জোড়া যুবক–যুবতী হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। হাঁটছে কয়েকটি পরিবারও। তাদের সাথের শিশুরাও ছোটাছুটি করছে। কিছু মানুষকে দেখলাম পানিতে দাবড়াচ্ছে। কী আনন্দ যে তারা করছে। জলকেলির ভাষা বুঝি পৃথিবীর সব দেশেই একইরকম।
বিচে ছাতা দেয়া আছে, ছাতার তলায় বিচ চেয়ারও পেতে রাখা। রঙিন ছাতার ছায়াতে বিচ চেয়ারগুলোও বেশ সুন্দর। ছাতার তলায় নানা বয়সী নারী পুরুষ। কেউ কেউ বসে আছেন, আবার কেউবা আধশোয়া। সাগরের ছোট ছোট ঢেউয়ের মাঝে তারা আনন্দ খুঁজছেন। এক একজনের চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক খেলা করছিল।
বিচের পাশে আবাসিক হোটেলগুলো থেকেও প্রচুর লোকজন বিচের দিকে আসছিলেন। কেউ কেউ হোটেলে ফিরে যাচ্ছিলেন। বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুডের দোকানপাটেও বেশ বিকিকিনি দেখা যাচ্ছিল। শুধু ফাস্টফুডের দোকানই নয়, আরো নানা ধরনের পণ্যের পসরা সাজানো দোকানে দোকানে। বিভিন্ন ধরণের স্যুভেনিরও বেশ নজর কাড়ছিল। জলকেলি করার নানা পোশাক–আশাকও দোকানগুলোতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। কিছুটা আমাদের মতো মনে হলেও আবার ঘোর কেটে যাচ্ছিল। কোথায় যেনো একটি পার্থক্য রয়ে গেছে। ঠিক যেনো চিরচেনার মাঝে অচেনা ভাব! বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমি ফিরতি পথ ধরার কথা বললাম। ড্রাইভারকে হংকং পোর্ট যদি কাছে হয় তাহলে একটু ঘুরিয়ে নেয়ার অনুরোধ করলাম।
ড্রাইভার বললো, খুব একটা কাছে নয়, তবুও ঘুরে যেতে পারবো। আমাদের হাতে সময় আছে। ড্রাইভার কিছুটা দ্রুত গাড়ি চালাতে শুরু করলো। আমরা আবারো ব্যস্ততম সড়ক ধরে ছুটছিলাম। হংকং বন্দর বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত বন্দরগুলোর একটি। চীনের সাংহাই বন্দরের মতো এই বন্দরের ব্যস্ততাও চোখে পড়ার মতো। হংকং বন্দরের প্রধান গেটে পৌঁছে আমার চোখ কপালে উঠতে শুরু করলো। হাজার হাজার কন্টেনার, অসংখ্য কী গ্যান্ট্রি ক্রেন। বড় বড় ক্রেনগুলো যেনো এই বন্দরের সক্ষমতার জানান দিচ্ছিলো। বছরে গড়ে প্রায় দুই কোটি কন্টেনার হ্যান্ডলিংকারী বন্দরটি শুধু কন্টেনারই নয়, কোটি কোটি টন খোলা পণ্যও হ্যান্ডলিং করে। আবার এই বন্দরের একপাশ থেকে নানা গন্তব্যে যাত্রীবাহী জাহাজও ছোটাছুটি করে। বছরে প্রায় আড়াই কোটি যাত্রী এই বন্দর দিয়ে নানা গন্তব্যে যাতায়াত করে। সবকিছু মিলে হংকং বন্দরের ব্যস্ততা অন্যরকমের এক আবহ তৈরি করেছে পুরো এলাকাটিতে। বন্দরের ভিতরে প্রবেশের কোন সুযোগ আমার নেই। পাস যোগাড় করার কথা চিন্তাও করতে পারলাম না। শুধু বাইরের রাস্তা ধরে ঘুরতে ঘুরতে ভিতরে যা দেখা যায়। খেয়াল করে দেখলাম যে, নদীর দুইপাড়েই বন্দরের অবকাঠামো, জেটি। দুই পাড়ে সমানতালে স্থাপন করা হয়েছে কন্টেনার হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট। ব্রিজ দিয়ে নদীর এপাড় ওপাড় সংযোগ ঘটানো হয়েছে। ইতোপূর্বে দেখা দৃষ্টিনন্দন ছিংমা সেতু এই বন্দরের সংযোগের ক্ষেত্রে কাজ করছে বলেও মনে হলো। আরো সেতু রয়েছে। তবে এসব সেতু নদী ভরাট কিংবা জাহাজ চলাচলের হুমকি হয়নি। সেতুগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যাতে নদীর স্রোতে কোন বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। নদীতে নদীর মতো রেখে কিংবা পাহাড়কে পাহাড়ের জায়গায় রেখে উন্নয়নের ষোলকলা পূর্ণ করার যে কৌশল হংকং রপ্ত করেছে তা আমাদের নেই। হয়তো মানসিকভাবেও আমরা ওই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারিনি। আমরা পাহাড় দেখলেই সাবাড় করি। শুধু পাহাড়খেকো ভূমিদস্যু নয়, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও আমাদের দেশে পাহাড় সাবাড় করে। অথচ হংকংয়ে পাহাড় কেটে নয়, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে উন্নয়নের সোনার হরিণের লালন পালন চলেছে, চলছে।
হংকং বন্দর যে কত বিশাল তা লিখে বুঝানো সম্ভব হয়। রাস্তা থেকে যতটুকু দেখা কিংবা বুঝা যাচ্ছিল তাতে বন্দরের কার্যক্রম বেশ বুঝতে পারছিলাম। বিশেষ করে উঁচু উঁচু ক্রেনগুলো জানান দিচ্ছিল যে, আমরা দাঁড়িয়ে থাকতে আসিনি, আমাদের জন্ম হয়েছেই উন্নয়নের জন্য। হংকং বন্দরে ৯টি স্বতন্ত্র টার্মিনাল রয়েছে। একই সাথে ২৪টি জাহাজ বার্থিং নিতে পারে। আমাদের এক একটি মাঝারী আকৃতির জাহাজ হ্যান্ডলিং করতে যেখানে দুই তিনদিনও লাগে, সেখানে বেশ বড়সড় জাহাজগুলো মাত্র দশ ঘন্টায় হংকং বন্দরে হ্যান্ডলিং করে। একটি জাহাজের আমদানি পণ্য বোঝাই কিংবা এমটি কন্টেনারের সবগুলো খালাস করে পুনরায় রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার জাহাজে বোঝাই করতে হংকং বন্দর সর্বোচ্চ দশ ঘন্টা সময় লাগায়। জাহাজ হ্যান্ডলিং এর এই সক্ষমতাই হংকংয়ে বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম রাজধানীতে পরিণত করেছে। এই বন্দরে বছরে প্রায় ৫ লাখ জাহাজ হ্যান্ডলিং করে! আমরা হাজার চারেক করি, আর ওরা করছে পাঁচ লাখ!! চোখ কপালে ওঠার জন্য এই একটি তথ্যই কী যথেষ্ট নয়! হংকং বন্দরের তথ্যগুলো দুচার লাইনে লিখে দিলেও এ যে কত বড় এক কর্মযজ্ঞ তার ছিটেফোঁটাও এতে বুঝা যাবে না। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, দীর্ঘদিন ধরে শিপিং রিপোর্টিং এর সাথে জড়িত থাকলেও হংকং বন্দর নিয়ে কিছু লিখে কাউকে বুঝানোর যোগ্যতা আমার নেই। আমি যতটুকু সম্ভব বন্দরটি দেখে অন্তত নিজে ধারণা করার চেষ্টা করছিলাম। এমন একটি বন্দর থাকলে সেদেশের উন্নতি যে ঠেকানো যায় না তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। না হয় হংকং এর পক্ষে এভাবে স্বপ্ন ছেুাঁয়া সম্ভব হতো না।
হংকং সরকারের মালিকানাধীন এই একটি বন্দর যে হংকংকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছে তা খোলা চোখেও দেখা যাচ্ছিল। আমাদের বন্দর থাকলেও হংকংয়ের মতো সেটি হয়ে উঠেনি। অর্থনৈতিকভাবে হয়তো হংকংয়ের ধারে কাছে যাওয়ার সুযোগ আমাদের নেই। অথবা হংকংয়ের মতো বন্দর করতে পারিনি বলেই সেই সুযোগ আমাদের হাতছাড়া হয়ে রয়েছে। নদীর দুইপাড়ে শহর বিস্তৃতির যে চিত্র হংকং কিংবা সাংহাইতে রয়েছে, আমাদের সেই সুযোগ থাকলেও কাজে লাগানো যায়নি। বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের পর সেই সম্ভাবনা তৈরি হলেও কতটুকু কাজে লাগানো যাবে তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।