ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষের কন্ঠে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক জনপ্রিয় গান ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম মইশখাইল্যা পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম।’ অপর একটি গান গেয়েছেন শিল্পী কান্তা নন্দীও। সেটির একটি বাক্য এমন ‘মনে করে মইশখালীর মিডা পান খাইতাম।’ উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী রুনা লায়লার কন্ঠে শোনা যায়-‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম বন্ধু ভাগ্য হইলো না…।‘ এই গানগুলো এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
খাবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে পান এই উপমহাদেশে প্রায় সবার কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত। তাদের কাছে পানের আবেদন যেন চিরদিনের। বিয়ে–বাড়িতে, বাসায় মেহমানদারিতে, আড্ডায়, বিভিন্ন উৎসবে পান একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে আলাদাভাবে। পান ছাড়া আচার–অনুষ্ঠান যেন অসম্পূর্ণ। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসেও দেখা মেলে পানের জনপ্রিয়তার চিত্র। আগেকার দিনে রাজা বাদশাদের খাবারের তালিকায় পান ছিল অন্যতম রাজকীয় খাবার। ভারতবর্ষের রাজা –বাদশাদের অন্দরমহলে পান খাওয়ার প্রচলন ছিলো বলেও জানা যায়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহান অন্দরমহলের নারীদের কাছে পান খাওয়া জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। শুধু রাজা–বাদশাহের দরবারে নয়, পানের গুণগান গাওয়া হয়েছে মধ্যযুগের অনেক কবি–সাহিত্যিকের লেখায়। আগেকার দিনে পান রাজা–বাদশাদের রাজকীয় খাবার থাকলেও, পান খাওয়ার প্রচলন এখন রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যেই। এই উপমহাদেশে ভ্রমণ করতে আসা অনেক পর্যটকের লেখায়ও উঠে এসেছে পানের কথা।
বিখ্যাত পরিব্রাজক ড.ফ্রান্সিস বুকাননের ভ্রমণকাহিনি থেকে জানা যায়, ২০০ বছরের অধিককাল আগেও মহেশখালীতে পানের চাষ হতো। তিনি ১৭৯৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির বোর্ড অব ট্রেডের নির্দেশে চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা ভ্রমণ করেন। কঙবাজার ভ্রমণকালে মহেশখালী দ্বীপে পানচাষিদের দেখতে পান। মহেশখালীর উঁচু পাহাড়ি জমি যেখানে পানি জমে না, সেসব জায়গায় তিনি পানের বরজের দেখা পান।বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালার কঙবাজার সিরিজে মহেশখালীতে তাঁর ভ্রমণের বিবরণ আছে। তিনি লিখেছেন, ‘ভোরবেলা আমি দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত পাহাড়ের দক্ষিণ–পশ্চিম প্রান্ত পরীক্ষার জন্য বের হলাম।… আদিগঞ্জ (বর্তমান গোরকঘাটা) থেকে আনুমানিক এক মাইল পশ্চিমে ডুমসাগাকাতালু নামে পরিচিত একটি উঁচু ভূমি রয়েছে, যার প্রান্ত বৃষ্টির পানি চলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ঢালু এবং যার মাটি অত্যন্ত ভালো। পানির অভাবে এ জমিতে চাষাবাদ হয়নি, তবে তার এক জায়গায় একটি পানের বরজ বা বাগান রয়েছে।‘
মহেশখালীর মিষ্টি পান পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে। যেখান থেকেই আসুক পর্যটকরা খেতে চায় মহেশখালীর এক খিলি মিষ্টি পান। এই সুযোগে বেড়েছে মিষ্টি পান বিক্রেতার সংখ্যা। বাহারি রং এ সাঁজিয়ে বিক্রি হচ্ছে মহেশখালীর মিষ্টি পান। এখানকার অধিবাসীদের অন্যতম সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পেশাও পান চাষ। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এর জমি পানচাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। মহেশখালীর পানের অন্যতম বিশেষত্ব হলো এর মিষ্টি স্বাদ, যার কারণে এই পান সারা দেশে বিখ্যাত। মহেশখালীর এই বিখ্যাত মিষ্টিপান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানিও করা হয়। এখানকার পানের সুনাম দেশের সীমানা পেরিয়ে এশিয়া মহাদেশ ছাড়াও ইউরোপ–আমেরিকা এমনকি আফ্রিকায়ও ছড়িয়ে রয়েছে। সমগ্র বাংলাদেশের দুই–তৃতীয়াংশ মিষ্টিপান মহেশখালী দ্বীপে উৎপাদিত হয়ে থাকে। বলা বাহুল্য,আকারে ছোট হলেও স্বাদে অনন্য হওয়ায় সারা দেশেই রয়েছে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মিষ্টি পানের কদর। মুখে দিয়ে চিবোলে দ্রুত মিশে যাওয়ার পর রেশ লেগে থাকে অনেকক্ষণ, কোনো ঝাল নেই, এটিই মহেশখালীর পানের বৈশিষ্ট্য। এই পান খাওয়া হয় হরেক পদের মসলা দিয়ে। মসলার স্বাদের ওপর নির্ভর করে পানের স্বাদ। নুরানি, শাহি, বেনারসি, এলাচি, জাফরান কত নাম যে আছে এ পানের, চট্টগ্রাম–কক্সবাজারের মানুষমাত্রই তা জানেন।
চট্টগ্রাম নগরের লাভ লেন, রেয়াজুদ্দিন বাজার, বহদ্দারহাট, কক্সবাজার ও মহেশখালীতে রয়েছে মিষ্টি খিলিপানের অসংখ্য দোকান। বস্তুত, পান চাষের জন্য বিশেষ দক্ষতা ও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা জরুরি। পানক্ষেতকে বলা হয় পানের বরজ। মহেশখালীর পানের বরজ সাধারণত দুই ধরনের– পাহাড়ি বরজ এবং বিল বরজ। উপজেলার বড় মহেশখালী, হোয়ানক, কালারমারছড়া, ছোট মহেশখালী ও শাপলাপুর ইউনিয়নের পাহাড়ের ঢালু ও সমতল কৃষি জমিতে যুগ যুগ ধরে পান চাষ করে আসছে স্থানীয় পানচাষিরা। জমির শ্রেণি অনুসারে পাহাড়ি এলাকার ভূমিতে পান চাষ দুই থেকে তিন বছর স্থায়ী হলেও সমতল জমিতে পান চাষ হয় মাত্র ছয় মাস। সমতল জমিতে সেপ্টেম্বর–অক্টোবর মাস থেকে শুরু হয়ে মে–জুনে শেষ হয়। অপরদিকে পাহাড়ি ঢালু জমিতে পান চাষ হয় বছরের যেকোনো সময়। শত বছরের ঐতিহ্য মহেশখালীর মিষ্টিপান এমন একটি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে শতভাগ দাবিদার।যা বলার অপেক্ষা রাখে না।
জিআই স্বীকৃতি হলো কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন পাস হয় ২০১৩ সালে।
২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিয়ে আসছে ডিজাইন, পেটেন্ট ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে পণ্যের স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে সরকারের এ বিভাগটি। এখন পর্যন্ত দেশে জামদানি, ইলিশ, রাজশাহীর সিল্ক, বগুড়ার দই, বাগদা চিংড়ি, কালিজিরা চালসহ ২১টি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে।
কোনো একটি পণ্য চেনার জন্য জিআই স্বীকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিআই স্বীকৃতি পাওয়া পণ্যগুলো অন্য দেশের সমজাতীয় পণ্য থেকে আলাদাভাবে চেনা যায়। এর ফলে ওই পণ্যের আলাদা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়।
‘জিআই স্বীকৃতি কি পাবে না মহেশখালীর মিষ্টি পান‘ (দৈনিক আজাদী,১০–০২–২০২৪) শীর্ষক প্রতিবেদনটি ইতিমধ্যে ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি‘তে পরিণত হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘মহেশখালীর মিষ্টিপানের শতবছরের খ্যাতিকে আড়াল করে মিষ্টিপানের জিআই স্বত্ব পেতে যাচ্ছে রাজশাহীর মিষ্টিপান। এই খবরে মহেশখালী কক্সবাজারের নানামহলে ক্ষোভের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, শত বছরের সুখ্যাতি থাকলেও অবহেলায় হয়নি আবেদন। এজন্য পিছিয়ে পড়তে যাচ্ছে মহেশখালীর মিষ্টি পান।‘ মহেশখালীর বিখ্যাত মিষ্টিপান চট্টগ্রামের গৌরব ও ঐতিহ্য। এটির জিআই স্বীকৃতি পাওয়া সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। এটাই চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক; ডেপুটি রেজিস্ট্রার,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।