পোশাক শিল্পের অদম্য জালালউদ্দিন

স্মরণ

সৈয়দ উমর ফারুক | রবিবার , ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৯:১১ পূর্বাহ্ণ

যখন পোশাক শিল্পের শিশুকাল, মানুষের কাছে এই শিল্পের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি। যখন শিল্প চালানোর জন্য জনবল সংকট, দক্ষ ও অভিজ্ঞ শ্রমিক বলতে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল নাএমন অপরিচিত শিল্পকে বুকে ধারণ করে চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারে একটি দালানে ক্লিফটন গার্মেন্টস নামে একটি পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে এক দুর্দান্তদুঃসাহসী অভিযাত্রায় বড় ভাই প্রফেসর ডিএমডি কামালউদ্দিনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন মেজ ভাই ডিএমডি জালালউদ্দিন। সততা, মেধা ও কর্তব্যনিষ্ঠার এক বিরল সম্মিলনে এই অদম্য জালালউদ্দিন মাত্র দশ বছরের মাথায় এই ক্লিফটন গার্মেন্টসকে বৃহত্তর শিল্পে রূপান্তর করে চমক দেখিয়েছিলেন।

আমার সাথে তাঁর পরিচয় এই শিল্প গড়ার অনেক পূর্বেই। আমার শৈশবের বন্ধু, কলেজিয়েট স্কুলের সহপাঠি সৈয়দ মোহাম্মদ সেলিমের বড় দুলাভাই হন প্রফেসর কামালউদ্দিন। আমাদের অনেক বন্ধুই তখন সেলিমের চকবাজারস্থ বাসায় স্কুল ছুটির পর লেখাপড়া এবং গল্পগুজবে সময় কাটাতাম। শহরের কেন্দ্রস্থলে তার বাসা হওয়ায় দূরদূরান্তের বন্ধুরা শহর এলাকার বাসে চড়ে এখানে আসত। সেলিম বন্ধু বৎসল এবং অতিথিপরায়ন। বাবা সৈয়দ কোম্পানী তখনকার দিনে মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে চট্টগ্রামে সাড়া ফেলেছিলেন। সে কারণে সৈয়দ কোম্পানীকে সাধারণ মানুষ সম্মানের চোখে দেখতেন। এই আলোচিত কোম্পানীর প্রথম কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন মিরসরাইয়ের প্রফেসর কামালউদ্দিন। তখন থেকেই জালালউদ্দিনের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা, তাঁদের সর্বকনিষ্ঠ ভাই ডিএমডি মহিউদ্দিন আমাদের বন্ধুও বটে। বর্তমানে সে পুরো ক্লিফটন গ্রুপ পরিচালনা করছেন। শিল্পের শত ব্যস্ততার মাঝেও লায়ন্স ক্লাবের গভর্নরের দায়িত্ব পালন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডে সে জড়িত।

জালালভাই মূলত: একজন বন্ধু বৎসল ও রসিক মানুষ ছিলেন। তাঁর আন্তরিকতার কারণে আমি ও সেলিম প্রায় সময় তার আন্দরকিল্লাস্থ চেয়ারম্যান গলির বাসায় বেড়াতে যেতাম। পোশাক শিল্পে জড়িত হওয়ার পর সেখানেও আমার যাতায়াত ছিল। তাঁর অফিসে ঢুকে সালাম দিতেই বলতেন ‘ফারুক ভাই বইয়েন’। চোখ তাঁর কাগজের দিকে। সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। আঙ্গুলের কাছাকাছি চলে এসেছে, আমি বললাম ‘তালত এবার সিগারেটটা ফেলে দেন’। আমার দিকে না তাকিয়েই ‘এসট্রে’তে তা ঘষে ফের কাগজপত্রে মনোনিবেশ করতেন। অনেকক্ষণ পর চোখ তুলে বললেন ‘কেমন আছেন’? বললেন ‘চা খান’। কাজের চাপ বেশি’। রফতানির জন্য ডকুমেন্ট রেডি করতে হচ্ছে। টার্মস এন্ড কন্ডিশন ঠিকমত না হলে ক্ষতির মুখে পড়ে যাব, তাই সব মন দিয়ে দেখতে হচ্ছে। এ কথা বলেই চুলের উপর দু’হাতের আঙ্গুল ঘষে বললেন, এই শিল্পে মজা আছে যদি কেউ সঠিকভাবে বুঝতে পারে।

আমি তাঁর সামনের চেয়ারে বসে ভাবছিলাম। আসলেই জালালভাই এই শিল্পের মজার মধ্যে অবগাহন করছেন। নয়তো কী সকাল, কী দুপুর, কী রাত একাগ্র মনে চেয়ারে বসেই পুরো শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। আমি বলি পোশাক শিল্পের এক অদম্য জালালউদ্দিন। ক্লিফটন গার্মেন্টস শুরু হওয়ার পর তিনি যেন সকল সুখশান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন এই শিল্পে। একজন শিল্পউদ্যোক্তার এই নিবেদনের কারণে দেশের মাঝে ক্লিফটন গ্রুপ অনন্য মাত্রায় ওঠে এসেছে।

তিনি বিদায় নিয়েছেন। তাঁর শেষ বিদায়টা অত্যন্ত নীরবে হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ‘কমা’য় ছিলেন সিঙ্গাপুর। তিনি বিদায় নিলেন তাঁর শ্রমের ফসল এই শিল্পে কাজ করছেন হাজারো নারীপুরুষ যাদের উপর নির্ভর করছে লক্ষ মানুষ। তিনি যেখানেই থাকুন শান্তিতে থাকুন। পরকালে তাঁর ভালো কাজের প্রতিদান নিশ্চয় সৃষ্টিকর্তা দেবেন।

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক চট্টগ্রাম মঞ্চ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধক্যানসার-যোদ্ধা সম্মাননা
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ