সংসারে প্রতিটি সদস্য কোনো এক সময় তাদের নিজস্ব ভূমিকার মূল্যায়নের সম্মুখীন হয়। সংসারে কার কী ধরনের ভূমিকা আছে কে কী কী করেছে, কে কীভাবে অবদান রেখেছে আর্থিক ভাবে কে কতটুকু সংসারে সাহায্য করেছে, শারীরিক ও মানসিকভাবে কে কতটুকু পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। শুন্য থেকে গড়ে উঠা প্রতিটি সংসারে একদিন না একদিন এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। বিশেষ করে যখন বাড়ির কর্তা ব্যক্তিটি উপার্জন করতে অক্ষম হয়ে যায়। ঘরের গৃহকর্তী যখন পারিবারিক কাজে তেমন হাত লাগাতে পারে না। তখনই এই প্রশ্নগুলো উঠে আসে। একটা সময়ের পরে মা –বাবা আর্থিক ও শারীরিক ভাবে সংসারের হাল ধরে রাখতে পারে না। তখনই প্রশ্নগুলো সন্তানের মুখ থেকে বার বার শুনতে হয়। সন্তানদের মাঝে যখন মা–বাবার দায়িত্ব নেওয়ার প্রশ্ন আসে তখন এই প্রশ্নগুলো অনায়াসে বিভেদের কারণ হয়ে যায়। একটি সংসারের শুরু থেকে প্রতিটি সন্তান সমপর্যায়ের আদর ভালোবাসা স্নেহ মায়া মমতা পেয়ে বড় হতে থাকে। মা –বাবার কাছে সব সন্তান সমান। কিন্তু সন্তানরা সেই সুযোগ সুবিধাগুলো সমপর্যায়ে কাজে লাগাতে পারে না। জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের ক্ষেত্রে সন্তানদের মাঝে পার্থক্য তৈরি হচ্ছে। এর জন্য সন্তান নিজেই দায়ী। তবুও মা–বাবার কাছে সব সন্তান সমান। সেই সন্তান যখন বড় হয়ে যায় তখন মা বাবাকে নিয়ে ভাগাভাগি করে। অথচ মাতৃগর্ভে এক নিয়মে বেড়ে ওঠে। একই ছাদের নিচে মা –বাবার শাসনে ও আদরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।
আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে বৃদ্ধ ও বয়স্ক ব্যক্তির অবস্থান তেমন সন্তোষজনক নয়। একেবারে নিম্ন আয়ের পরিবারের মানুষগুলো জীবন জীবিকার বাস্তবতায় সংসারের সকলে গাদাগাদি করে বসবাস করে থাকে। অনেকে সেই কৈশোর ও শৈশব অবস্থায় জীবিকার তাগিদে অর্থ উপার্জনের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। জীবনটা ওরা ওদের মত করে সাজিয়ে নেয়। একেবারে নিম্ন আয়ের পরিবারে বৃদ্ধ মানুষটি ভিক্ষা করতে রাস্তায় নামে। কিন্তু দিন শেষে আবার ঘরে ফিরে আসে। কারণ বৃদ্ধাশ্রমে রাখার মতো সামর্থ্য নেই বলে হয়তো সবাই একসাথে একই ছাদের নিচে বসবাস করে। তারা ভালোবাসার ও মায়ার টানের চেয়ে কঠিন বাস্তবতার কারণে একসাথে খাওয়া দাওয়া করে। একসাথে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ করে জীবনের মায়া ছেড়ে একদিন না ফেরার দেশে চলে যায়। আমাদের সমাজে একক ও ছোট পরিবারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবারের বয়স্ক ও বৃদ্ধ মানুষটি কোনও এক সময় পরিবার থেকে ছিটকে যায়। সন্তানদের মাঝে ভাগাভাগি শুরু হয় মা–বাবার দায়িত্ব নিয়ে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা আবার নিজের সাধ্যমত আলাদা সংসারের ব্যবস্থা করে। অনেক সন্তান নিরাপত্তার কথা ভেবে মা–বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। কখনো কখনো দায়িত্ব মনে করে দেখতে যায়। আবার কখনো কখনো অপারগতার কথা বলে একটি বিশেষ অংকের টাকা পাঠিয়ে দূর থেকে দায়িত্ব পালন করে। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মানুষগুলো দিনের শেষে আপনজনের অপেক্ষায় থাকে। সেই দূরের আলো দেখা পর্যন্ত প্রধান ফটকের দিকে তাকিয়ে থাকে। অপেক্ষায় থাকে একটা ফোন আশার। ভাবতে থাকে, ফোনের ওপারে বলবে কেমন আছো? কেমন আছো তুমি? এই শব্দগুলো বারবার শুনতে চায়। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা একজন জন্মদাতা বাবা ও গর্ভধারিণী মা শুধুমাত্র একটি শব্দ শোনার জন্য সারাদিনই যেন অপেক্ষায় থাকে। সন্তানের মুখে সেই শব্দটা হচ্ছে–মা ও বাবা। বিবাহিত জীবনের শুরু হতে সকল নতুন দম্পতি এই মা–বাবা শব্দ শুনার জন্য অপেক্ষায় থাকে। তার চেয়ে বেশি আগ্রহে থাকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মানুষগুলো। সারাক্ষণ মা–বাবা ডাক শুনার অপেক্ষায় থাকে। ফোনে একটা রিং বাজলে প্রত্যেকে মনে করে হয়তো ওনার ফোন এসেছে। বারবার ফোনের দিকে তাকায়। এভাবে দিন যায়। সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। প্রতিদিন এভাবেই অপেক্ষা করে কিন্তু বাস্তবতার কাছে হার মানতে হয়। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। নিষ্ঠুর করুন অভিজ্ঞতাগুলো বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মানুষগুলোর জীবন সম্বন্ধে ধারণা পাল্টিয়ে দেয়। জীবনকে যেভাবে তাঁরা প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করে ছিলেন ঠিক সেভাবে জীবনের শেষ প্রান্তে জীবনকে সাজাতে পারে না। গ্রহণ করতে পারেন না।
পবিত্র কোরআন শরীফে মহান আল্লাহতালা বলেছেন আমি মানুষকে শুক্রবিন্দু হতে সৃষ্টি করেছি। এরপর একটি মাংসপিণ্ড সৃষ্টি করেছি। কিছুদিন মাতৃগর্ভে রেখে পরিপূর্ণ করে তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছি। জীবনের প্রাথমিক দিকে মানুষকে দুর্বল করে পাঠিয়েছি। জীবনের শুরুতে প্রত্যেক ব্যক্তি অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকে। আস্তে আস্তে নিজের উওপর দাঁড়াতে পারে। এক সময় সামর্থ্যবান মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলে। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে মানুষ আবার দুর্বল হতে থাকে। প্রকৃতির নিয়মে বার্ধক্যের দুর্বলতায় অসহায়ত্ব বোধ করে। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন শরীফে বলেছেন, তোমরা মা–বাবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হও। মা–বাবার প্রতি তোমাদের দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন কর। বৃদ্ধ বয়সে তাদের প্রতি বিরক্ত হবে না। কিন্তু বাস্তবতা অনেক অনেক বেশি নিষ্ঠুর। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মানুষগুলোর করুণ অভিজ্ঞতা পরিবার ও সমাজের বাস্তবতা সম্পর্কে ভাবিয়ে তোলে। প্রতিষ্ঠিত সন্তান থাকা সত্ত্বেও তারা অসহায়। সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও অনেককে বৃদ্ধাশ্রমে মৃত্যুবরণ করতে হয়। মৃত্যুর পর আপনজন আবার দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে যেমন অবহেলিত হয়েছে ঠিক সেভাবে অবজ্ঞার শিকার হয় চির বিদায়ের বেলায়। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মানুষগুলো এক সময় মনে করেন যাদের জন্য জীবন সংগ্রাম করতে করতে ক্লান্ত তাদের কাছেই এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্পত্তি ভাগাভাগির সময় সবাই সমান ভাগ চায়। পারলে অন্যকে ঠকিয়ে আরও বেশি নিতে চায়। কে কাকে ঠকিয়ে নিবে এই প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। শুধু মা–বাবার দায়িত্ব নেওয়ার সময় সবাই পিছপা হয়। কাকে কখন বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় তার কোনও ঠিক নেই। জীবনমুখী ও বাস্তব মুখী শিক্ষা দিয়ে সন্তান লালন পালন করা উচিৎ। শুধু প্রতিষ্ঠিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সন্তান লালন পালন করা উচিত নয়। পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব গুলো শৈশব থেকে শিশুকে শিখানো উচিৎ। বাস্তবভিত্তিক জীবনমুখী শিক্ষায় সন্তানকে লালন পালন করতে হবে। শিশু–কৈশোর–তরুণ–মধ্যবয়স–বৃদ্ধ এই চক্রকারে প্রত্যেকটি মানুষকে অতিবাহিত করতে হবে। শুধু বর্তমানে নিজেকে বিচার না করে অতীত–বর্তমান–ভবিষ্যতের–ছকে ফেলে জীবনকে ভাবা উচিত। প্রত্যেক মানুষের জীবনে এই জীবন চক্র আসতে পারে। প্রত্যেক মানুষকে হয়তো বৃদ্ধ বয়সে করুণার সম্মুখীন হতে পারে। পারিবারিক পরিবেশে জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করার আনন্দই সকলের জীবনের একমাত্র চাওয়া–পাওয়া। দিনের শেষ আলোতেও যেন নতুন প্রভাতের আভা পাওয়া যায় সেভাবেই পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হোক।
লেখক : কলামিস্ট; অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ডা. ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রী কলেজ,চট্টগ্রাম।