কমলকুমারের চলচ্চিত্র সংযোগ নিয়ে গ্রন্থ

ভাষার মাস বইয়ের মাস

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু | শুক্রবার , ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ১১:৪৮ পূর্বাহ্ণ

একটি চিতা সাজান হইয়াছে, উপর বর্তমান সত্য যেন বা স্মৃতি হইয়া দেখা দেয়, যেখানে নক্ষত্র নাই, চিতার নিকটে বসিয়া একটি ক্রন্দনরত বালক, সে লাউডগারুগ্ন সুন্দর পিণ্ড হাতে করিয়া বসিয়া আছে, তথাপি তাহার ক্রন্দনে আকাশ আঁকা ছিল, তখনো লহরীতত্ত্ব ছিল।”

(অন্তর্জলী যাত্রা)

এভাবেই লিখেছেন কমলকুমার মজুমদার তাঁর অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাসের দৃশ্যপট। এমনভাবে লেখা, পড়তে পড়তেই পুরোটাই ভেসে ওঠে। এমন গদ্যরচনাবাংলা সাহিত্যে বিরল। কেন বিরল? তা গবেষণার বিষয়। কমলকুমার মজুমদারকে আমরা যদি শুধু ঔপন্যাসিক হিসেবে দেখি, তাহলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই কথাটি স্মরণে আনতে হয়। সুনীল কমলকুমারের সম্পর্কে বলেছিলেন: “একটি ছোট অথচ মনোযোগী পাঠক গোষ্ঠী তৈরী করবেন বলেই যেন কমলকুমার তাঁর কাহিনীগুলোতে ভাষার বর্ম দিন দিন আরও সুদৃঢ় করেছেন।” সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই মন্তব্য বা অনুধাবন কমলকুমার সম্পর্কে, পাঠক হিসেবে যথেষ্ট ভাবনা তৈরি করে। এতবছর পরও দেখি, কমলকুমারের পাঠক কিন্তু সত্যিই ছোট অথচ মনোযোগী।

এই হলো কমলকুমার মজুমদার। যিনি বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর মানুষ। সাহিত্য, নাটক, চিত্রকলা, চলচ্চিত্রসবদিকেই তিনি ভ্রমণ করেছেন। এমন মানুষের চলচ্চিত্রের প্রতি অনুরাগচলচ্চিত্রচিন্তা ইত্যাদি নিয়ে সমপ্রতি একটি গ্রন্থ লিখেছেন শৈবাল চৌধূরী। গ্রন্থের নাম কমলকুমার মজুমদার ও চলচ্চিত্র সংযোগ।

শৈবাল চৌধূরী দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে যুক্ত। নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা থেকে কমলকুমার মজুমদারের নানাবিধ সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে খুঁজেছেন চলচ্চিত্র সংযোগ নিয়ে। বিষয়টি বেশ চমকপ্রদ। কারণ, কমলকুমারের উপন্যাস নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। যেগুলো হয়েছে আলোচিত, প্রশংসিত, পুরষ্কৃত। কিন্তু সেই চলচ্চিত্রগুলো নিয়েও নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। কমলকুমারের উপন্যাসের ঘ্রাণ কী চলচ্চিত্রে পাওয়া যায়? কিংবা গেছে? ঔপন্যাসিক কমলকুমার মজুমদার যেমন আলাদা সত্তার, তেমনি আবার চলচ্চিত্র যিনি নির্মাণ করেছেন, তিনিও ভিন্ন সত্তার। তাই সাহিত্য ও চলচ্চিত্রএ দুইয়ের সংযোগ ঘটানোর দুরূহ কাজটি করেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ( নিম অন্নপূর্ণা এবং তাহাদের কথা) ও গৌতম ঘোষ ( অন্তর্জলী যাত্রা)। এই দুই নির্মাতা যে সাহস করে কমলকুমারের সাহিত্য অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তার জন্য আমরা চলচ্চিত্রমোদী তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। ভিন্ন আঙিকে কমলকুমারকে আরও বিশদ জানা ও চেনার সুযোগ আমরা পেয়ে যাই। এই বিষয়ে গ্রন্থকার শৈবাল চৌধূরী লিখেছেন: কমলকুমার মজুমদারের সাহিত্য অবলম্বনে সার্থক চলচ্চিত্র নির্মাণ রীতিমত দুরূহ কাজ। অত্যন্ত মেধাবী নির্মাতা ছাড়া একাজে সার্থকতা অর্জন তেমন সম্ভবপর নয়।” ( পৃ: ১৪, ১৫)

কমলকুমার মজুমদারের চলচ্চিত্র জগতের একজন ঘনিষ্ঠজন ছিলেন, তা হয়তো আমাদের অনেকেরই অজানা। আলোচ্য এই বইয়ে তা জানার সুযোগ হয়েছে। এই প্রসঙ্গে গ্রন্থাকার লিখেছেন : “কমলকুমার যে চলচ্চিত্রস্নাত একজন মানুষ ছিলেন, শিল্পের সর্বকনিষ্ঠ ও আধুনিক এ মাধ্যমটি নিয়ে যে তাঁর বিশেষ চিন্তাভাবনা ছিল, রীতিমত চর্চা ছিল, ছিল নিজস্ব চলচ্চিত্রবোধ, এসব নিয়ে আমাদের জানাটুকু সাধারণভাবে স্বল্প।তিনি নিজেও যে চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী ছিলেন এবং বারকয় উদ্যোগীও হয়েছিলেন, চলচ্চিত্র বিষয়ে লিখেওছেন এবং সম্পাদনা করেছেন চলচ্চিত্র বিষয়ক গ্রন্থ (মলয় চন্দন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদিত গ্রন্থ ‘চলচ্চিত্র’) এসব বিষয়ে সাধারণ অবহিতি কম।” (পৃ. ১৪)

রীতিমতো চমকে যাওয়ার মতোই এই তথ্য।

সত্যজিৎ রায়ের সাথে কমলকুমার মজুমদারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পারস্পরিক কাজের প্রতি সহমর্মিতা ছিল। এই প্রসঙ্গে কমলকুমার মজুমদারের স্ত্রী দয়াময়ী মজুমদারের একটি লেখা শৈবাল চৌধূরী উল্লেখ করেছেন। যেখানে দয়াময়ী মজুমদার জানাচ্ছেন: “নিয়মিত সিনেমা দেখতেন তিনি। সত্যজিৎ রায় ছিলেন ঘনিষ্ঠজন”(পৃ.২৪)। বলাবাহুল্য, এই সম্পর্কের কারণেই আমরা আরেকটা দিক জানতে পারি। “পথের পাঁচালী’র চিত্রনাট্য রচনাকালে দু’জনের সান্নিধ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গ্রামবাংলার অনেক খুঁটিনাটি বিষয়াদি, প্রবচন, প্রবাদ, উপকরণ ইত্যাদি সম্বন্ধে কমলকুমার নিয়মিত অবহিত করতেন সত্যজিৎকে। চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী কমলকুমারের মন ভরাতে পারেনি। এনিয়ে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য জমেছিল। যা কিঞ্চিৎ দূরত্বও তৈরি করে, তবে তা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের তারতম্য ঘটায়নি” (পৃ.২৪২৫)। সম্পর্ক যেটুকু থাকুক, কমলকুমার মজুমদার যে তাঁর সৃষ্টির প্রতি, কতটা অনুরাগী ও নিষ্ঠাবান ছিলেন, তা অনুমান করা যায়। গ্রামের বর্ণনা কিংবা প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার প্রয়াসী তিনি। চলচ্চিত্রের ভাষায় হয়তো বা ততটা বিশদ আনা কতটুকু সম্ভবতা যিনি নির্মাতাতার উপরই বর্তায়। এক্ষেত্রে দ্বিমত থাকা অপ্রাসঙ্গিক নয়। কমলকুমার মজুমদার এবং সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। উদার মনের মানুষ ছিলেন বলেই সত্যজিৎ রায় বলেছেন: “পথের পাঁচালী ছবিটা উনি দেখতে চাননি। দেখার কোনো আগ্রহও দেখিনিখুব অভিমান হয়েছিল। কমলবাবুকে খুশী করার মতো পল্লী জীবন নিয়ে ছবি করার ক্ষমতা আমার নেই।”(পৃ.২৫)

এরপর আর কোনো কথা থাকে না। এই দুই বড়ত্বের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থেকেই যাবে।

কমলকুমার মজুমদার বাংলা সংস্কৃতির যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তা সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমের দিকপালদের বিভিন্ন সময়ে আলাপে উঠে এসেছে। পূর্ণেন্দু পত্রী বলছেন: “এমনও মনে হতে পারে কমলকুমার জীবনকে দেখেছেন এবং দেখতে চেয়েছেন একজন শিল্পীর চোখ দিয়েই।কিংবা এমনও হতে পারে যে তাঁর ছোটগল্পগুলো পেইন্টিং আর উপন্যাসগুলো ভাস্কর্য। পেইন্টিং থাকে আমাদের চোখের লেভেলে। ভাস্কর্যের অবলোকনে আমাদের যেমন প্রদক্ষিণ করতে হয় চারপাশ, তেমনি তাকাতে হয় Daie অধঃ জুড়ে।” ( পৃ:২৭)

পূর্ণেন্দু পত্রীর এই পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শিল্পচর্চায় কমলকুমার মজুমদার এত বিস্তৃত বিচরণ করেছেন, তা বিচ্ছিন্নভাবে কিংবা আলাদাভাবে দেখার অবকাশ নেই। কমলকুমার মজুমদারের জীবনের বৈশিষ্ট্য এমনই।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জাঁ রেনোয়া নিজেও কমলকুমার মজুমদারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এই বিষয়ে জাঁ রেনোয়া হরিসাধন দাশগুপ্তকে বলেছিলেন, কমলকুমার সদৃশ ব্যক্তিত্ব দীপ্র ও গুণধর মানুষ বঙ্গভূমে তিনি আর দেখেননি।” (পৃ. ২৭)

এই প্রসঙ্গে শৈবাল চৌধূরী লিখেছেন: কমলকুমার মজুমদারের চলচ্চিত্রচিন্তার একটি নিজস্বতা ছিল। আন্তর্জাতিক শিল্প মাধ্যমটিকে তিনি তাঁর নিজস্ব ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিতে পুনঃস্থাপিত করতে ভালোবাসতেন। ” (পৃ: ২৬) এখানে আমরা ভিন্ন এক কমলকুমার মজুমদারকে দেখতে পাই। গল্পকার কিংবা ঔপন্যাসিক নয়। একজন চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক হিসেবে তাঁর গুণের পরিচয় মেলে।

কমলকুমার মজুমদার ও চলচ্চিত্র সংযোগ” গ্রন্থটিতে এভাবেই বর্ণিত হয়েছে কমলকুমার মজুমদারকে নিয়ে; যেখানে আছে কেবলই বিস্ময় শিল্পীর শিল্পচর্চা ও ভাবনার দর্শন বিষয়ে উন্মোচন। শৈবাল চৌধূরী লিখিত এই গ্রন্থটি পাঠে কমলকুমার মজুমদারের অনেক অজানা বিষয় জানার সুযোগ করে দিয়েছে। এমন আলোচনা কমলকুমারকে নিয়ে নিশ্চয় আরও হবে। আরও বিষয় উন্মোচিত হবে। এই গ্রন্থটি পাঠে কমলকুমার সম্পর্কে মৌলিক ধারণা পাওয়া যাবে। শৈবাল চৌধূরী এক্ষেত্রে কমলকুমারের চলচ্চিত্র সংযোগ নিয়ে কাজ করেছেন। যে বিষয়গুলো আমাদের অনেকেরই অজানা। তথ্যের সমন্বয়টাও চমকপ্রদ। এজন্য গ্রন্থাকার শৈবাল চৌধূরীকে সাধুবাদ জানাই। এই গ্রন্থের আলোচনাটি শেষ করি সত্যজিৎ রায়ের উক্তি দিয়ে: “কমলবাবু একজন আর্টিস্ট, কমপ্লিট আর্টিস্ট। ক্যামেরাতুলি চালিয়ে উনি ভাষার চিত্র আঁকেন। কমলবাবু গ্রেট।”

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাওয়াভাষ্য
পরবর্তী নিবন্ধহিসাবটা শেষ পর্যন্ত এক শতাংশ পাঠকের