নামায মি’রাজের শ্রেষ্ঠ উপহার
আল কুরআনে নামাযের নির্দেশনা: নামায আল্লাহকে স্মরণের উৎকৃষ্ট মাধ্যম। পবিত্র মিরাজ রজনীতে আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় হাবীবের উপর শ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে মি’রাজ দান করেছেন। বান্দা শরীয়তের বিধান অনুসরণে নির্ধারিত পদ্ধতিতে সুনির্দিষ্ট সময়ে বিনীতভাবে আল্লাহর সমীপে দন্ডায়মান হয়ে আল্লাহর মহত্ত ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য নিজের বিনয় ও অক্ষমতা ধারন করে দৈনিক পাঁচবার স্রষ্টার সমীপে সিজদাবনত হয়। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আমাকে স্মরণের জন্য তোমরা নামায কায়েম কর।” (২:১৪)
তিনি আরো এরশাদ করেছেন, “ আর নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ।” (২৯:৪৫)
সকল প্রকার অন্যায় অপরাধ থেকে বান্দাকে মুক্ত রাখাই হলো নামাযের উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় নামায অশ্লীলতা ও অন্যায় থেকে বিরত রাখে।” (সূরা: আল আনকাবূত: ৪৫)
তাফসীরে ইবনে কাসীরে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তির নামায তাকে অশ্লীল ও অসঙ্গত কাজ হতে বিরত রাখেনা তার নামায নামাযই নহে। দুঃখ জনক হলেও সত্য যে বর্তমানে অনেক নামাযী আছেন যারা দৈনিক পাঁচ বার নামাযও আদায় করেন, তাদের কপালে সিজদার দাগ ও চিহ্নও পড়েছে অথচ তারা মিথ্যাচার পাপাচার যৌনাচার মিথ্যা সাক্ষী, অবৈধ লেনদেন, শঠতা কপটতা প্রতারণাসহ সকল প্রকার অপকর্মে জড়িত রয়েছে। মূলত: তারা ইবাদতের মূল শিক্ষা নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ইসলামের মূল শিক্ষা ও ইবাদতের তাৎপর্য তাদের আচরণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার কারণে তাদের ব্যক্তি জীবনে তাকওয়ার প্রভাব পড়েনি, ইসলামের বাহ্যিকরূপকে তারা ধারণ করে আছে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি করতে না পারায় নামাযের আধ্যাত্নিক প্রভাব তাদের জীবনে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
মি’রাজ রজনীতে আল্লাহর দিদার লাভ, উপহার হিসেবে নামাযের তোহফা অর্জন: সাতাশ রজব সোমবার দিবাগত রজনীতে আল্লাহ তা’আলা তার হাবীবকে উর্ধ্বজগতের মহান মেহমান করে ধন্য করেন। নবীজি আল্লাহর সাথে স্বশরীরে সাক্ষাৎ অর্জন, সৃষ্টির বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন, নবীজিকে অসংখ্য নিয়ামত দ্বারা সম্মানিত করেন, শ্রেষ্ঠ উপহার পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায প্রদান করা হলো, নবীজি আল্লাহর পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ উপহার নিয়ে উর্ধ্বালোক থেকে আসমানের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন। পথিমধ্যে হযরত মুসা (আ.)’র সাথে নবীজির সাক্ষাৎ হয়। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, মুসা (আ.) নবীজিকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ তা’আলা আপনাকে কি আদেশ করেছেন? নবীজি বললেন দিবারাত্রি পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায আদায়ে আদিষ্ট হয়েছি। মুসা (আ.) বললেন, আপনার উম্মত খুবই দূর্বল যে তারা পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায আদায়ে সক্ষম হবেনা। আপনি পূনরায় স্বীয় প্রভূর নিকট গমন করুন। এ আদেশ সহজতর করার জন্য আবেদন করুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে গেলেন এবং নামাযের সংখ্যা কমানোর জন্য আল্লাহর সমীপে আবেদন করেন, এরপর মুসা (আ.)’র নিকট আগমন করেন, তিনি নবীজিকে আবার অনুরূপ পরামর্শ দিলেন নবীজি আল্লাহর দবরারে আবার ফিরে গেলেন, এভাবে মুসা (আ.)’র পরামর্শে বারবার ফিরে গিয়ে আবেদন করতে করতে শেষ পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায অবশিষ্ট রয়ে গেল। তিনি নবীজিকে আবারো আল্লাহর দরবারে গিয়ে নামযের সংখ্যা কমানোর আবেদন করার পরামর্শ দিলেন নবীজি বললেন আমি আবার আবেদন করতে লজ্জাবোধ করছি। আমি এতে সন্তুষ্ট, আমি তা মেনে নিলাম এখন আমি সামনে অগ্রসর হলাম অদৃশ্য হতে আওয়াজ হলো, আমি ফরজকে অবধারিত করলাম ও আমার বান্দাদের থেকে হ্রাস করলাম। (সহীহ বুখারী, মিশকাতুল মাসাবীহ, পৃ: ৫২৮)
আল্লাহ তা’আলা তাঁর হাবীবকে সম্বোধন করে বললেন, হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিবা–রাত্রি পাঁচ ওয়াক্ত নামায অবধারিত, প্রত্যেক ওয়াক্তের জন্য দশগুণ সাওয়াব, ফলে পঞ্চাশ ওয়াক্ত হয়েছে। যে ব্যক্তি একটি নেক আমল করার ইচ্ছা পোষণ করলে তা না করলেও তার জন্য একটি নেকী লিখা হবে, আর যদি আমল করা হয় দশগুণ সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হয়, পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মন্দ কাজের ইচ্ছা করে তা না করলে কোনো কিছু লিখা হয় না, যদি মন্দ কাজ বাস্তবে পরিণত করে তাহলে একটি গুনাহ লিখা হয়। (মুসলিম শরীফ)
শবে মিরাজের ইবাদত: উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, রজব সেই মহিমান্বিত মাস যে মাসের নেকীর সওয়াব আল্লাহ বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। যে ব্যক্তি এ মাসে একদিন রোজা রাখল সে যেন পূর্ণ এক বৎসর রোজা রাখল, যিনি এ মাসে সাত দিন রোজা রাখবে তার জন্য দোজখের সাতটি দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যিনি এ মাসে আট দিন রোজ রাখবে তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেয়া হবে। এ মাসে দশদিন রোজা পালনকারী আল্লাহর নিকট যা প্রার্থনা করবে আল্লাহ তা দান করবেন, যে এ মাসে পনের দিন রোজা পালন করবে অদৃশ্য থেকে আহবান করা হয় ওহে রোজাদার! তোমার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, নেক আমল করো, যে যতবেশী নেক আমল করবে তাকে অধিক সওয়াব দান করা হবে। (মা–সাবাতা বিসসুন্নাহ, আনুবাদ–পৃ:১৭০)
হযরত আবু উমামাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, পাঁচ রাত্রিতে দুআ ফেরত দেয়া হয় না। ১. রজবের প্রথম রজনীর দুআ, ২. চৌদ্দ শাবান দিবাগত রজনী, ৩. জুমার রজনী, ৪. ঈদুল ফিতরের রজনী, ৫. ঈদুল আযহার রজনী। (মুকাশিফাতুল কুলুব, (আরবি) পৃ: ৪৪৯)
সিদরাতুল মুনতাহা গমন: মিরাজের দুলহা রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি সিদরাতুল মুনতাহা পরিদর্শন করেছি সিদরাতুন অর্থ বরই বৃক্ষ, সপ্ত আসমানে সীমায় বরই বৃক্ষ। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, এর একটি বরই হিজর নামক স্থানের মটকার মত এবং পাতাগুলো হলো হাতির কানের মত। জিবরাঈল (আ.) সিদরাতুল মুনতাহা পৌঁছে থেমে যায়, আমি বললাম হে জিবরাঈল! এমন স্থানে এসে কোন বন্ধু কি বন্ধুকে পরিত্যাগ করে? জিবরাঈল (আ.) বললেন, আমি যদি আর একটু অগ্রসর হই। তবে আমার পাখাগুলো জ্বলে ছাই হয়ে যাবে। (মাওয়াহেবে লুদুনীয়া, খন্ড:২, পৃ: ২৯)
ইমাম কুস্তুলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ছাড়া অন্যকেউ সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেত পারেননি। (মাওয়াহেবে লুদুনীয়া, খন্ড:২, পৃ: ২৫)
বায়তুল মা’মুর: বায়তুল মামুর হলো ফিরিস্তাদের কিবলা, কাবা শরীফের বরাবর ঠিক উপরের দিকে বায়তুল মামুর অবস্থিত। মানুষ যেভাবে জমীনে খানায়ে কাবার তাওয়াফ করে থাকে, ফেরেস্তারা অনুরূপ বায়তুল মামুরের তাওয়াফ করে থাকে। প্রত্যেক দিন সত্তর হাজার ফেরেস্তা বায়তুল মা’মুর এর তাওয়াফ করে থাকে যে, একবার তাওয়াফ করে সে দ্বিতীয় বার তাওয়াফ করার সুযোগ পায় না। বায়তুল মামুরে সত্তর হাজার ফেরেস্তা নবীজিকে অভ্যার্থনা জানান। বায়তুল মামুরে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফেরেস্তাদের ইমামত করেছেন। (রুহুল বয়ান, খন্ড: ৫, পায়গামে মিরাজ, পৃ: ১৬৫)
জাহান্নামে বেনামাযীদের শাস্তি: মিরাজ রজনীতে নবীজি জাহান্নাম পরিদর্শন করলেন, এতে এমন এক সম্প্রদায়ের সাথে নবীজির সাক্ষ্যৎ হলো যাদের মাথা পাথর দ্বারা ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়া হচ্ছে এবং পূনরায় তা আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসছে এ অবস্থা অব্যাহতভাবে চলছে। এ অবস্থা অবলোকন করে নবীজি হযরত জিবরাঈল (আ.) কে জিজ্ঞেস করলেন এরা কারা? জিবরাঈল (আ.) জবাব দিলেন এরা ঔইসব লোক যারা নামায আদায় করে না। (মাওয়াহেবে লুদুনীয়া, খন্ড:২, পৃ:১৫, মাদারেজুন নবুওয়াত, খন্ড:১, পৃ: ২৯৮)
জাহান্নামে যাকাত পরিত্যাগকারীর শাস্তি: মিরাজ রজনীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাথে যাকাত পরিত্যাগকারী সম্প্রদায়ের সাথে সাক্ষ্যৎ হলো, যাদের লজ্জাস্থান অগ্রে এবং পশ্চাতে বস্ত্রখন্ড আবৃত ছিল, তারা চতুস্পদ জন্তুর মত বিচরন করছিল এবং জাহান্নামের “যরী” যাক্কুম নামক কণ্ট কাকীর্ণ বৃক্ষ ও জাহান্নামের পাথর ভক্ষণ করছিল, নবীজি জিজ্ঞেস করলেন এরা কারা? হযরত জিবরাঈল (আ.) বললেন, এরা হলো যারা স্বীয় মালের যাকাত আদায় করত না। (মাওয়াহেবে লুদুনীয়া, খন্ড: ২, পৃ: ১৫, মাদারেজুন নবুওয়ত, খন্ড:১, পৃ: ২৯৮)
জাহান্নামে ব্যভিচারীর শাস্তি: মি’রাজ রজনীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাথে সাক্ষাৎ হলো যাদের সামনে এক পাতিলে রান্নাকৃত মাংস এবং অপর পাতিলে কাচা মাংস রয়েছে, তারা পচা মাংস খাচ্ছে রান্না করা মাংস খাচ্ছে না। রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন এরা কারা? হযরত জিবরাঈল (আ.) বললেন, এরা আপনার উম্মতের ঐসব লোক যাদের নিকট বৈধ হালাল স্ত্রী ছিল তবুও তারা যিনা ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়েছে অথবা তারা আপনার উম্মতের ঐই সমস্ত নারী যাদের হালাল বৈধ স্বামী ছিল তবুও তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে। (মাওয়াহেবে লুদুন্নীয়া, খন্ড:২, পৃ: ১৫, আনোয়ারে মুহাম্মদীয়া, পৃ: ১৩৫), হে আল্লাহ আমাদেরকে মি’রাজের উপহার পাঁচ ওয়াক্ত নামায যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন।
অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম।
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।