ক্ষমতা পেলে অধিকাংশ বাঙালির মাথা বিগড়ে যায়। তারা ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মনে করে। তাই যা ইচ্ছে তা করে। কোনোদিন জবাবদিহি করতে হতে পারে বা ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে জনরোষে পড়তে পারে সে কথা তাদের মনে থাকে না।
সমপ্রতি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এমন কয়েকটি ঘটনার প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে চট্টগ্রামবাসী তথা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের। ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দলছুট হয়ে গেলে, মাথার ওপর থাকা হাতটি সরে গেলে, কিংবা ক্ষমতা খর্ব হলে তার পরিণাম কী হয় তা পটিয়া, বাঁশখালী, সাতকানিয়ার সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।
সামপ্রতিক একটি ঘটনার তথ্য তুলে ধরলে আলোচনা করার সুযোগ হবে।
সাতকানিয়া–লোহাগাড়ার সোনাকানিয়া ও বড়হাতিয়া বনের প্রায় আড়াই হাজার একর বনভূমি জবর দখল করে কৃত্রিম হ্রদ তৈরি করে ‘স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি‘। অবৈধ এ লেকে মাছ চাষ করা হয়েছিল। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এ লেক নির্মাণ করা হয়। লেকটি তৈরি করা হয়েছে সরকারি বনের ভেতরে সোনাকানিয়া নামের একটি ছড়ায় বাঁধ দিয়ে। বাঁধের দৈর্ঘ্য ২০০ ফুট, প্রস্থ ২০ ফুট ও উচ্চতা ১০০ ফুট। বন বিভাগের দাবি, কৃত্রিম লেক তৈরির কারণে গামারি, সেগুন, চিকরাশি, অর্জুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট–বড় প্রায় পাঁচ লাখ গাছ মরে গেছে। লেকে ডুবে যাওয়া জায়গার মধ্যে বন্য হাতির চলাচলের পথ ছিল। খ্যাঁকশিয়াল, শজারু, বন্য শূকর, বনমোরগ, ময়ূর, গুইসাপ, অজগরসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী এবং নানা প্রজাতির পাখি বাস করত। হঠাৎ কৃত্রিম লেকের কারণে এ জীববৈচিত্র অনেকটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, বাঁধ দিয়ে লেক সৃষ্টির কারণে ছড়ার পানি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে লোহাগাড়া ও সাতকানিয়ার ৪ হাজার ২৫৫ একর জমির চাষাবাদ ব্যাহত হয়েছে।
স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি কারা? বাংলাদেশের মানুষ মাত্রই জানেন, স্থানীয় সংসদ সদস্যের ওপর ‘স্থানীয় প্রভাবশালী‘ আর কেউ থাকেন না, থাকার সুযোগই নেই। একজন সংসদ সদস্যকে তাঁর এলাকায় একজন রাজাই বলা চলে। তাঁর অনুমতি ও অনুমোদন ছাড়া কিছু করা বা হওয়া সম্ভব নয়। কিছু ব্যতিক্রম সব জায়গাতে থাকেন, তাঁদের নিয়ে বলছি না। আমি অধিকাংশের কথা বলছি। বনের এই ক্ষতি করার পেছনে যে ক্ষমতাবান ব্যক্তির নাম এসেছে তিনি হলেন সাতকানিয়ার তৎকালীন সংসদ সদস্য। বন বিভাগের দাবি, তদন্তে অভিযোগের (অবৈধ লেক) সত্যতা পাওয়ার পর আইনি প্রক্রিয়া শুরু করলেও সদ্য সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য (চট্টগ্রাম–১৫) আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভীর কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। নদভী ওই সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি কখনো আগে আওয়ামী লীগ করেননি। একজন জামায়াতের অর্থ সংগ্রাহক হিসেবেই পরিচিতি ছিল তাঁর। স্বাধীনতার পর ৭৩ সালের নির্বাচনের পর সাতকানিয়া থেকে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী জয়লাভ করতে পারেনি। ১৯৭০– সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আওয়ামী লীগ। ১৯৭৩– এম সিদ্দিক। আওয়ামী লীগ। ১৯৭৭– মোশতাক মিঞা জাগদল।
১৯৮৬ ও ৮৮ ইব্রাহিম খলিল। জাতীয় পার্টি ১৯৯১– শাজাহান চৌধুরী। জামায়াত। ১৯৯৬ কর্নেল অলি। বিএনপি। ২০০১ শাজাহান চৌধুরী। জামায়াত। ২০০৮ শামসুল ইসলাম। জামায়াত।
১৪ ও ১৮ সালে আওয়ামী লীগের টিকেটে জিতেছিলেন জামায়াত থেকে আসা নদভি। এবারও তিনি মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু মাথার ওপর থাকা এতদিনের আশীর্বাদের হাতটি সরে যাওয়ায় দলীয় মনোনয়ন পাওয়া সত্ত্বেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর (তিনিও আওয়ামী লীগ হতে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন)) দাপটের কারণে নদভী নির্বিঘ্নে দলীয় প্রচারও চালাতে পারেননি। ফলে নির্বাচনের আগেই তিনি তাঁর এলাকায় হিরো থেকে জিরোতে পরিণত হয়েছিলেন। এখন আর তিনি স্থানীয় ‘প্রভাবশালী ব্যক্তি‘ নন। এখন বনবিভাগ খুব সহজেই তাঁর নাম উচ্চারণ করতে সাহস পাচ্ছে। এই সাহস দেখাতে গিয়ে উত্তেজনাবশত তাঁরা এক চরম বেকুবের মতো কাজ করেছে। রাতারাতি লেকের বাঁধ কেটে দিয়ে স্থানীয়দের ব্যাপক ক্ষতি করে দিয়েছে।
বনের ক্ষতি করে লেক তৈরির খবর পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর বন বিভাগ তড়িঘড়ি করে লেকের বাঁধটি কেটে দেয়। তাতে নতুন করে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে স্থানীয়রা। হঠাৎ করে ঘোষণা ছাড়া ওই বাঁধ কেটে দেয়ায় শীতের রাতে পানিতে ভেসে গেছে সাতকানিয়া–লোহাগাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা, অর্ধশতাধিক মাটির ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। পানির প্রবল তোড়ে উপজেলার সোনাকানিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র মির্জাখীল বাংলাবাজার পুরোটাই পানির নিচে তলিয়ে যায়। প্রবল স্রোতে ১টি স্লুইসগেট ভেঙে গেছে। বিপুল পরিমাণ জমির ধানের চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলাকাবাসী জানিয়েছে, রাতে লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়ার পর পশ্চিমের পাহাড় থেকে বাঁধের পানি পার্শ্ববর্তী সাতকানিয়ার সাইরতলী, তাঁতীপাড়া ডুবে যায়। এরপর একে একে কুতুবপাড়া, মঙ্গলচাঁদ পাড়া পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। এই পানি একসময় এসে পৌঁছায় সোনাকানিয়ার মির্জাখীল গ্রামে। মির্জাখীল বাংলাবাজার ব্যবসায়ীদের প্রচুর মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে বাংলাবাজারের ভাসমান দোকানিদের পণ্যসামগ্রী মুহূর্তেই পানিতে ভেসে যায়।
সোনাকানিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দীন সাংবাদিকদের জানান, বিনা নোটিশে বাঁধের পানির ছেড়ে দেয়ার কারণে ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও সাড়ে ৩ শতাধিক বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবজিক্ষেত, পুকুরের মাছ, রাস্তাঘাট, বাজারসহ ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বাঁধ ভাঙার জন্য আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে সব ধরনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাঁধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রভাবশালী হওয়ার কারণে সফল হইনি। অভিযোগের পর তদন্তে সত্যতা পেয়ে সংশ্লিষ্ট বিট কর্মকর্তা মামলার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন এমপি মহোদয়ের হস্তক্ষেপে তখন মামলা করা হয়নি।’
কৃষকদের অভিযোগ, বাঁধ নির্মাণ ও হ্রদ তৈরিতে জড়িত ব্যক্তিরা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা নেজামুদ্দীন নদভীর একান্ত সচিব ও জেলা পরিষদের সদস্য এরফানুল করিমের ঘনিষ্ঠ। সোনাইছড়ি ছড়া পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি শামসুল আলম একটি দৈনিককে বলেন, ‘আমরা ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি। তবে বাঁধ নির্মাণ থেকে শুরু করে হ্রদ পরিচালনা করেন মূলত দুজন মো. নাছির উদ্দিন ও মনজুর আলম। তাঁরা সাবেক এমপির ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কেউ কিছু করার সাহস পায়নি এত দিন।’
এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ না করে উপায় নেই। একদিকে ক্ষমতার অপব্যবহার অন্যদিকে বনবিভাগের কর্মকর্তাদের নির্বুদ্ধিতা। বন দখল করার সময় তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে আবার ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগে রাতারাতি বাঁধটি কেটে চরম বোকামির পরিচয় দিয়েছে। বাঁধ কাটার আগে তাদের ভাবা উচিত ছিল এত পানি হঠাৎ ছেড়ে দিলে কী পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এটা অত্যন্ত সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপার। এরজন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ারও প্রয়োজন নেই। বনের আশপাশের বাসিন্দারা বলেন, লেকে শুষ্ক মৌসুমে পানির গভীরতা থাকে ৪৫ ফুট আর বর্ষায় গভীরতা বেড়ে প্রায় ৬০ ফুট পর্যন্ত হয়। এত পানি হঠাৎ ছেড়ে দিলে কী হতে পারে, সে পানি কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে, কত পরিমাণ ভূমি তলিয়ে যাবে এসব না ভেবে যারা এত মানুষকে কষ্টে ফেলেছে এবং এত সম্পদ বিনষ্ট করেছে তাদের কী হবে? পার পেয়ে যাবে? আমি তো মনে করি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং ‘স্থানীয় প্রভাবশালীদের‘ বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করা উচিত।
লেকে মাছচাষ হতো। নিয়মিত বড়শি প্রতিযোগিতার নামে চলত মূলত জুয়া। জানা গেছে, লেক তৈরির সঙ্গে জড়িতরা মূলত সেখানে অবৈধভাবে একটি বেসরকারি পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলো। আমার মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো, নদভী যদি এবারও জিততেন তাহলে কি বাঁধটি কাটা হতো? উত্তরটি আমরা জানি, কাটা হতো না। এবং বনের রক্ষিত ও সংরক্ষিত জায়গা দখল করে সেখানে অচিরেই একটি পর্যটন তথা বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলা হতো যেখানে নদভীর চেয়েও ক্ষমতাধর ব্যক্তি, সরকারি এমনকি বনবিভাগের বড় বড় কর্তাব্যক্তিরা অবকাশ যাপনে আসতেন আর ‘স্থানীয় প্রভাবশালীদের‘ বিচক্ষণতার তারিফ করতেন। তবে সবকিছুর শেষ আছে। সেটা খুব ব্যাখ্যা না দিয়েই বলতে পারি চট্টগ্রামের পটিয়া, বাঁশখালী ও সাতকানিয়ার অভিজ্ঞতা থেকেই তার শিক্ষা নিতে পারি।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক