মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২০ লাখের বেশি প্রবাসী কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগেই সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্সযোদ্ধা আছেন। বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দেন চট্টগ্রাম বিভাগের রেমিটেন্সযোদ্ধারা। তবে এই বিভাগে রেমিটেন্সযোদ্ধা বেশি থাকলেও বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর পরিবর্তে হুন্ডির ব্যবহার বেড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠানো একটি বিপজ্জনক ধারা। বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ানো গেলে দেশের অর্থনীতির শঙ্কা কেটে যাবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিভাগের ২০ লাখ ৫১ হাজার ৯৫২ জন রেমিটেন্সযোদ্ধা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। এই সংখ্যা দেশের মধ্যে সর্বাধিক। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। চট্টগ্রাম থেকে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ কমে ঢাকা বিভাগের রেমিটেন্সযোদ্ধা রয়েছেন ১৪ লাখ ৩১ হাজার জন। ইংল্যান্ডে বিপুল সংখ্যক সিলেটের মানুষের বসবাস হলেও তৃতীয় স্থানে থাকা সিলেট বিভাগের প্রবাসীর সংখ্যা ৫ লাখ ৭৩ হাজার জন। বিবিএসের জরিপে বলা হয়েছে, দেশের মোট রেমিটেন্সভোগী পরিবারগুলোর মধ্যে সর্বাধিক রয়েছে চট্টগ্রামে, ৩৫.২ শতাংশ। ঢাকা বিভাগে ৩০.৫ শতাংশ এবং সিলেটে ১০.১ শতাংশ। রেমিট্যান্স গ্রহণকারী পরিবারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম সংখ্যা হচ্ছে রংপুর বিভাগের, মাত্র ২.৪ শতাংশ।
প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত দেয়ার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখছে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সদ্য সমাপ্ত ২০২৩ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসীরা ২১.৯২ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন। ২০২২ সালে এর পরিমাণ ছিল ২১.২৯ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে রেমিটেন্স এসেছে ২.১০ বিলিয়ন ডলার। এটি গত সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১.৯৮ বিলিয়ন ডলার। প্রবাসীদের প্রেরিত এই রেমিটেন্স বৈদেশিক বাণিজ্য এবং ঋণ সমন্বয়সহ লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্ত ভিত দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ। শুধু জাতীয় অর্থনীতি নয়, স্থানীয় এবং গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার ক্ষেত্রেও রেমিটেন্স প্রবাহ বড় ধরনের ভূমিকা রেখে আসছে। রেমিটেন্স আহরণের দিকে বাংলাদেশ বিশ্বের নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম।
চট্টগ্রাম জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামের প্রবাসীরা বছরে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠান। চট্টগ্রামের বিপুল সংখ্যক মানুষ সৌদি আরব, ওমান, কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যবসা এবং চাকরি করে অর্জিত আয়ের প্রায় পুরোটাই দেশে পাঠিয়ে থাকেন।
উন্নত দেশগুলোতে বসবাসকারীদের প্রেরিত রেমিটেন্সের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ইউরোপ–আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে বসবাসকারী অনেক প্রবাসী উল্টো দেশ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যান। তারা সেখানে সম্পদ গড়েন, বাড়িঘর কিনেন। বিদেশে গিয়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলোই রেমিটেন্স প্রবাহ গতিশীল রেখেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের রেমিটেন্সযোদ্ধারা বছরে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা দেশে পাঠান, যা দেশের অর্থনীতিতে গতি আনছে।
রেমিটেন্স প্রবাহ প্রসঙ্গে খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামে রেমিটেন্সযোদ্ধা বেশি, এটা ভালো খবর। তবে দুঃখজনক হচ্ছে, প্রবাসীদের অনেকেই বৈধ চ্যানেলে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠান। বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স না এলে আমাদের আমদানি খরচ মেটানো কিংবা ব্যালেন্স অব ট্রেডের ঘাটতি মেটাতে সমস্যা হয়। ফর্মাল চ্যানেলে টাকা না আসায় কারেন্ট একাউন্টে ঘাটতি দেখা দেয়। তাই আমাদের রিজার্ভ অনেক কমে গেছে। রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন তা ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠানো একটি বিপজ্জনক ধারা মন্তব্য করে মইনুল ইসলাম বলেন, এই ধারা থামাতে হবে। এটা থামানো গেলে আমাদের অর্থনীতিতে আর কোনো সংকট থাকবে না। এটা থামানো না গেলে আমাদেরকে বিপদে পড়তে হবে।