পবিত্র কুরআনের আলোকে মি’রাজ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ প্রদত্ত অসংখ্য মু’জিযা সমূহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও বিস্ময়কর মু’জিযা হলো মিরাজুন্নবী। আল্লাহ তা’আলা তাঁর কুদরত প্রমাণের জন্য তাঁর নবীদেরকে বিশেষ বিশেষ মু’জিযা দান করেছেন। পিতা–মাতা ছাড়া হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা। মাতা বিহীন হযরত হাওয়া (আ.)কে সৃষ্টি করা, পিতা বিহীন হযরত ঈসা (আ.) কে সৃষ্টি করা এসব ছিল আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন। হযরত মুসা (আ.)’র হাতের লাটি সর্পে রূপান্তর হওয়া, হযরত ঈসা (আ.) কর্তৃক মৃতকে জীবিত করা, জন্মান্ধ ব্যক্তিকে দৃষ্টি শক্তি দান করা, কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান করা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আঙ্গুলী মুবারকের ইশারায় আসমানের চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা, হযরত আলী (রা.)’র জন্য অস্তমিত সূর্য উদিত করা, পাথর ও কংকর কলেমা পাঠ করা, বৃক্ষরাজি নবীজির আহবানে সাড়া দেওয়া, নবীজির নুরানী আঙ্গুলী মুবারক থেকে পানির ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হওয়া ইত্যাদি ছিল নবীদের মু’জিযা, আল্লাহর কুদরত, নবীদের মু’জিযার মাধ্যমে বিকশিত হয়। নবীর মু’জিযা অস্বীকার করা প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর কুদরত অস্বীকার করার নামান্তর। মি’রাজের ঘটনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “পবিত্র ও মহামহিম তিনি যিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছিলেন। মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসার আশে পাশে পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাঁকে আমার নিদর্শনাবলী অবলোকন করানোর জন্য নিশ্চয় তিনি সর্ব শ্রোতা সর্বদ্রষ্টা। (সূরা: বনী ইসরাঈল, ১৭:১)
মিরাজ অর্থ: মিরাজ অর্থ সিঁড়ি বা সোপান যেহেতু আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় হাবীবকে জান্নাতী সোপানের মাধ্যমে উর্ধ্বলোকে ভ্রমন করিয়েছেন এ কারনে এ ভ্রমণকে মিরাজ বলা হয়, মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত এবং মসজিদে আকসা থেকে সপ্তাকাশ ও সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় যে ভ্রমণ করানো হয়েছে একেই মিরাজ নামে অভিহিত করা হয়।
মিরাজের ঘটনা: নবুয়ত প্রকাশের একাদশতম বৎসর হিজরতের পূর্বে সুপ্রসিদ্ধ মতানুসারে রজব মাসের ছাব্বিশ তারিখ দিবাগত রাতে সোমবার নুরানী রজনীতে মিরাজ ঘটিত হয়েছিল। নবীজি এশার নামায আদায়ের পর তাঁর চাচাতো বোন হযরত উম্মেহানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার ঘরে বিশ্রাম করছিলেন তখনো নবীজির ভালোভাবে নিদ্রা আসেনি কিছু টা তন্দ্রাভিভূত ছিলেন এমন সময় দেখলেন ঘরে ছাঁদ ফাঁক হয়ে গিয়েছে ফাঁক দিয়ে হযরত জিবরাঈল (আ.) ঘরে প্রবেশ করলেন তাঁর সাথে রয়েছেন কতিপয় নুরানী ফেরেস্তা। জিবরাঈল (আ.) নবীজিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে মসজিদুল হারামে নিয়ে গেলেন সেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাতীমে কাবায় ঘুমিয়ে পড়লেন। (ফাতহুল বারী, খন্ড: ৭, পৃ: ২৫৬)
হযরত জিবরাঈল (আ.) ও হযরত মিকাঈল (আ.) এসে নবীজিকে পূনরায় জাগিয়ে যমযমের কাছে নিয়ে গেলেন সেখানে নবীজির শক্কে ছদর তথা বক্ষ বিদারণ করলেন, নবীজির কলব মোবারক বের করে যমযমের পানি ধারা তা ধৌত করলেন আর একটি র্স্বণের তশতরি পাত্র আনা হলো যা ঈমান ও প্রজ্ঞা দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল অত:পর তা যথাস্থানে রেখে দিলেন। (বোখারী শরীফ, পৃ: ৯৭৬, হাদীস: ৩৮৮৭)
অত:পর স্কন্ধের মাঝে মহরে নবুওয়াত লাগানো হলো বস্তুত এটা ছিল তাঁর সর্বশেষ নবী হওয়ার বাহ্যিক নিদর্শন।
বোরাকের উপর আরোহন: অত:পর একটি জান্নাতী বোরাক আনা হলো নবীজি এরশাদ করেছেন, এটি ছিল জান্নাতী বাহন। এটি ছিল খচ্চর হতে ছোট, গাধা থেকে বড়, সাদা রং এর লম্বা আকৃতি সম্পন্ন এর গতি ছিল বিদ্যূৎসম। এর গতি সীমার অবস্থা এমন ছিলো যে দৃষ্টি সীমায় নিজের কদম রাখতো, উচুতে উঠার সময় তার হাত ছোট এবং পা লম্বা হয়ে যেত, আর নীচে নামার সময় হাত লম্বা ও পা ছোট হয়ে যেত, যার কারনে উভয়ক্ষেত্রে তার পিট সমান থাকতো, এতে আরোহীর কোনো ধরনের কষ্ট হতো না, (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৩৮৮৭)
বোরাক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশে রওয়ানা হলো।
যাত্রাপথে তিনস্থানে নামায আদায়: সাহাবী হযরত সাদ্দাদ ইবনে আউস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, বায়তুল মুকাদ্দাস যাওয়ার সময় আমি এমন ভূমির উপর দিয়ে পথ অতিক্রম করেছি যেখানে প্রচুর পরিমাণে খেজুর বৃক্ষ রয়েছে এ স্থানে পৌঁছিলে জিবরাঈল (আ.) আমাকে বললেন, এ স্থানে নেমে দু’রাকাত নামায আদায় করুন। আমি দু রাকাত নামায আদায় করলাম। অত:পর জিবরাঈল (আ.) বললেন, এ স্থানটি ইয়াসরীব তথা আপনি মদীনা তৈয়্যবায় নামায পড়েছেন আপনি হিজরত করে এখানেই আশ্রয় গ্রহণ করবেন। সামনে অগ্রসর হলেন কিছু দুর যাওয়ার পর জিবরাঈল (আ.) বললেন, এখানে অবতরণ করে নামায আদায় করুন, আমি নামায পড়ে নিলাম জিবরাঈল (আ.) বললেন, আপনি “তুরে সীনায়” সিনাই উপত্যাকায় নামায পড়েছেন, এ স্থানে আল্লাহ তা’আলা হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এর সাথে কথা বলেছিলেন, সফর চলতে থাকলো, কিছু দূর যাওয়ার পর জিবরাঈল (আ.) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন বোরাক হতে অবতরণ করে এ স্থানে নামায আদায় করুন, নামায আদায় করলাম নামায শেষে জিবরাঈল (আ.) বললেন যে স্থানে নামায পড়েছেন এর নাম হলো বায়তুল লাহম এ স্থানেই হযরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এ স্থানটি বায়তুল মুকাদ্দাসের দক্ষিণে ৬ মাইল দূরত্বে অবস্থিত। (সীরাতুল মুস্তফা, ১ম খন্ড, পৃ: ২৯০–২৯১)
বরকতময় স্থান সমূহে নামায আদায়: মিরাজ গমনকালে রসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আল্লাহর প্রিয় মাহবুব বান্দাদের সাথে সম্পর্কিত স্থানসমূহে নামায আদায়ের মাধ্যমে প্রতীয়মান হলো আল্লাহর নবী অলীদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান সমূহে নামায পড়া বরকতের কারন ও মাধ্যম। (নাশরুত তীব, পৃ: ৯২, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ২, পৃ: ৪১৮)
হযরত মুসা (আ.) কর্তৃক কবর শরীফে নামায আদায়: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি মুসা আলাইহিস সালাম এর কবর এর নিকট দিয়ে অতিক্রম করেছি, তিনি স্বীয় কবরে নামায আদায় করছেন। (মুসলিম শরীফ, খন্ড: ২, পৃ: ২৬৮, মুদারেজুন নবুওয়ত, খন্ড:১, পৃ: ২৯৫)
বায়তুল মুকাদ্দাসে অবতরণ: রসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়তুল মুকাদ্দাস পৌছলেন যেখানে মসজিদে আকসা অবস্থিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোরাককে মসজিদের দরজায় লাগানো আংটার সাথে বাঁধলেন। পরে হযরত জিবরাঈল (আ.) বোরাককে মসজিদের আঙ্গিনায় নিয়ে আসেন এবং নিজের আঙ্গুল দ্বারা একটি পাথর ছিদ্র করে তাঁর সাথে বেঁধে দিলেন। (সীরাতে হলবিয়া)
এই দরজাকে “বাবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম” বলা হয়ে থাকে। (মুসলিম, খন্ড: ১, পৃ: ৯১)
নবীজি মসজিদুল আকসায় তাশরীফ নিলেন, হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম নবীজিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অপেক্ষমান সকল সম্মানিত নবীগন, মাহবুবে খোদাকে দেখে আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং নবীজির প্রতি দরুদ সালামের হাদিয়া পেশ করলেন, সকল নবীগন আমাদের আক্বা সরকারে দোআলম হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হওয়ার স্বীকৃতি দিলেন। (মুদারেজুন নবুওয়ত, পৃ: ২৯৫)
আজান দেয়া হলো, তাকবীর বলা হলো, হযরাতে আম্বিয়ায়ে কেরাম কাতারবদ্ধ হলেন হযরত জিবরাঈল (আ.) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নামাযের ইমামতি করার জন্য সবিনয় অনুরোধ জানালেন, নবীজি সকলের ইমামতি করলেন, মিরাজ রজনীতে সকল নবীগন ছিলেন মুক্তাদি আমাদের নূর নবীজি হযরত মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ইমামুল আম্বিয়া।
আসমানে আরোহন: আরশে আজীমের মেহমান হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, জিবরাঈল (আ.) এবং অপরাপর ফিরিশতাগনের সঙ্গে আসমানের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। বিভিন্ন রিওয়ায়াত সূত্রে জানা যায় যে, জান্নাত থেকে মনিমুক্তা খচিত একটি সিঁড়ির মাধ্যমে তিনি আসমানে আরোহন করেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি এরশাদ করেছেন, যখন আমি বায়তুল মুকাদ্দাসের কার্যক্রম সমাপ্ত করলাম তখন একটি সিঁড়ি আনা হলো, আমি এর চেয়ে উত্তম সিঁড়ি আর কখনো দেখিনি। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩ খন্ড, পৃ: ১১০, শরহে মাওয়াহিব, খন্ড: ৬, পৃ: ৫৫)
হাফিয ইবনে কাছীর বর্ণনা করেন, বুরাক মসজিদুল আকসার দরজায় বাঁধা ছিল, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসমানী সফর শেষ করে সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করে আল্লাহর দিদার শেষে আসমান থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসে ফিরে আসেন অত:পর ঔই বুরাকের উপর আরোহন করে মক্কা মুকাররমায় প্রত্যাবর্তন করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড: ৩, পৃ: ১১০, সীরাতুল মুস্তফা, ১ম খন্ড, পৃ: ২৬১)
মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রিয় হাবীবের শ্রেষ্ঠত্ব অনুধাবন করার জন্য মিরাজের তাৎপর্য বুঝার তাওফিক দান করুন। আমীন।
অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম।
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
আশফাকুর রহমান
কমল মুন্সির হাট, চক্রশালা, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: মি’রাজ রজনীতে ইবাদত করার ফযীলত সম্পর্কে জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: ইসলামে রজব মাসের বরকতময় রাত্রি ২৭ রজব রজনীতে ইবাদতের অসংখ্য ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি এ রজনীতে বার রাকআত নামায আদায় করবে প্রত্যেক রাকআতে সূরা ফাতেহা পাঠের পর কুরআন মজীদের যে কোনো সূরা পাঠ করবে দ্বিতীয় রাকআতে তাশাহুদ ও দরুদ শরীফ পড়ে সালাম ফিরাবে। এভাবে বার রাকআত পড়ার পর একশত বার এই তাসবীহ পাঠ করবে “সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়া লা–ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর” অত:পর একশতবার আসতাগফিরুল্লাহ এবং একশত বার দরুদ শরীফ পাঠ করে দুনিয়া আখিরাতের যে কোনো বিষয়ে প্রার্থনা করবে, পরদিন রোজা পালন করবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা তাঁর সকল প্রার্থনা কবুল করবেন। তবে শর্ত হলো কোন প্রকার গুনাহের দুআ যেন না হয়। (এহইয়াউল উলুম, খন্ড: ১ পৃ: ৩৭৩, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড:২, পৃ: ৪৪৯)