সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য প্রায় সময় দাতা দেশ ও সংস্থা সমূহ তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। পেশাগত প্রশিক্ষণ অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দক্ষতা বৃদ্ধি ও অভিজ্ঞতা অর্জনে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। কিন্তু কার প্রশিক্ষণ কে নেয়? এমন সব কাজে প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশে কর্মকর্তাদের প্রেরণ করা হয় যার সাথে তার কাজের কোনও সম্পর্ক নেই। এভাবে অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হয় না। যারা বিদেশে যান তারা ‘প্রমোদ ভ্রমণ‘ এর আনন্দ উপভোগ করেন বটে, তবে ফিরে এসে দেশকে কিছু দিতে পেরেছেন, এমন নজির তেমন একটা মেলে না।
দীর্ঘদিন ধরেই প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ সফর নিয়ে দেশে একটি হ–য–ব–র–ল অবস্থা চলে আসছে। সাম্প্রতিক একটি ঘটনা এই বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে অনেক প্রশ্নসহ। গত ২০ জানুয়ারি বাংলাদেশ বিমানের একটি বোয়িং ৭৮৭–৯ ড্রিমলাইনার (অচিনপাখি) ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে সৌদি আরবের দাম্মাম যাচ্ছিল। ফ্লাইটটির ক্যাপ্টেন ছিলেন নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য চিত্রনায়ক ফেরদৌসের স্ত্রী তানিয়া রেজা। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার দুই ঘণ্টা পর বিমানের ককপিটের উইণ্ডস্ক্রিনে ফাটল লক্ষ্য করেন ফ্লাইট ক্যাপ্টেন। সাথে সাথে তিনি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ করে ভারতের আকাশসীমা থেকে বিমানটি আবার ঢাকায় নিয়ে আসেন। সমূহ একটি বিপর্যয় থেকে এভাবে রক্ষা পান ২৯৭ যাত্রী ও ড্রিমলাইনারটি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানি থেকে এটিসহ নতুন দুটি ড্রিমলাইনার ক্রয় করে। এই দুটি বিমান ডেলিভারি নিতে দুই দফায় ৪৫ জনের প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে। এজন্যে ব্যয় হয় ৭ কোটি টাকার মত। ৪৫ জনের এই দলে ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পদস্থ কর্মকর্তা, বিমানের ইঞ্জিনিয়ার, কেবিন ক্রু, এয়ার হোস্টেস সহ বিমান সংশ্লিষ্ট নন এমন অনেক কর্মকর্তা। এই ড্রিমলাইনার দুটি মাঝেমধ্যেই মাঝ আকাশে বিগড়ে যায়। মাঝপথ থেকে ফিরে আসতে হয়। জরুরি অবতরণও করতে হয় যাত্রাপথে। সম্প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত ড্রিমলাইনারটির জন্য সিঙ্গাপুর থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন উইণ্ডস্ক্রিন আনা হয়েছে। মেরামত শেষে আবার বহরেও যুক্ত হবে। অন্য ড্রিম লাইনারটিতে নানা সমস্যা দেখা গেছে এর আগে। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, যারা বিমান দুটি ডেলিভারি নিতে আমেরিকা গিয়েছিলেন রাষ্ট্রের ৭ কোটি টাকা ব্যয় করে, তারা কী দেখেছিলেন? দেশে আনার পর থেকেই বিমান দুটি যে ঝামেলার সৃষ্টি করছে তার দায় কি তারা এড়িয়ে যেতে পারেন? এ রকম আরও একটি ঘটনার কথা বলি। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের সিংহভাগ আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আমদানিকৃত খাদ্য, গুড়োদুধ ইত্যাদি খালাসের পূর্বে এর তেজস্ক্রিয়তা মান পরীক্ষা করাটা জরুরি। এই পরীক্ষার জন্য আমদানিকৃত পণ্যের নমুনা বাইরে বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে হয় রিপোর্টের জন্য। এতে করে কনসাইনি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। এ জাতীয় পণ্য বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয় একই ধরনের জটিলতা। এই জটিলতার অবসান ঘটাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় চট্টগ্রাম বন্দরে স্থাপন করা হয় ‘রেডিয়েশন ডিটেকশন ইকুইপমেন্ট’। বিপুল অর্থ স্থাপিত অত্যাধুনিক এই কমেন্ট পরিচালনার জন্য মার্কিন কোম্পানি সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। প্রশিক্ষণে যারা যান তাদের যাবতীয় ব্যয়ভার সরবরাহকারী উক্ত মার্কিন কোম্পানি বহন করে। ইকুইপমেন্ট বসানোর পর এটি যাতে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যায় সেজন্যেই এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশিক্ষণে তাদেরই যাওয়ার কথা ছিল যারা সার্বক্ষণিকভাবে বন্দরে অবস্থান করে উক্ত বিভাগের কার্যাদি পরিচালনা করবেন। কিন্তু আমেরিকা যাওয়ার এমন একটি সুযোগ কি সহজে হাতছাড়া করা যায়? তাই আমলারা সংশ্লিষ্ট টেকনিশিয়ান এবং অন্যদের বাদ দিয়ে নিজেরাই চলে যান এই ট্রেনিং নিতে।
ইকুইপমেন্ট পরিচালনার ট্রেনিং নিতে যারা আমেরিকা গিয়েছিলেন তারা ফেরার পথে দেখে আসেন শ্রীলংকার কলম্বো বন্দর। সেখানে এই ধরনের ইক্যুপমেন্ট আগে বসানো হয়েছে। যারা এই ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলেন ফিরে এসে কেউই এই ইকুইপমেন্ট পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। আবার টিমে এমন সদস্যও ছিলেন যিনি দেশে ফেরার দুদিন পর অবসরে চলে যান। ঘটনাটি যদিও এক দশক আগের তবে এই হচ্ছে আমাদের দেশের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। যাদের প্রশিক্ষণ পাবার কথা, তারা প্রশিক্ষণে যেতে পারেন না। যারা প্রশিক্ষণে যান, তাদের সেই প্রশিক্ষণ দেশের কোনও কাজে লাগে না। আলোচ্য ক্ষেত্রেও দেখা গেছে চট্টগ্রাম বন্দরে স্থাপিত ইকুপমেন্টটি প্রশিক্ষিত লোকের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে থাকতে অথবা পরবর্তীতে বিপুল অর্থ ব্যয়ে সংশ্লিষ্টদের আবার প্রশিক্ষণে পাঠাতে হচ্ছে।
প্রশিক্ষণ নিয়ে এই অরাজকতা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। কোনওভাবেই একে রোধ করা যাচ্ছে না। এমন সব প্রশিক্ষণে ঊর্ধ্বতন আমলারা বিদেশে যান, যেগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইদানীং ব্যাপক হাস্যরসের সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন সাঁতার শিখতে বিদেশ যাওয়া, ঘি–মাখন তৈরি শিখতে বিদেশ যাওয়া, মৎস্য চাষ ও মাশরুম চাষ শিখতে বিদেশ যাওয়া, বিশেষ উঁচু ভবন দেখে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে বিদেশ যাওয়া, কাজুবাদাম চাষ শিখতে বিদেশ যাওয়া, মৌমাছি লালন–পালন শিখতে বিদেশ যাওয়া – এ ধরনের অনেক হাস্যকর প্রকল্পের কথা দেশের জনগণ সংবাদপত্রের কল্যাণে জানতে পারছে।
‘পুকুর খনন ও খাল খনন উন্নয়ন’ এই শিরোনামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল মেয়াদে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১,৩৩৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে এসে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করে করা হয় ২,২৫৫ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের অধীনে ১০০ কর্মকর্তা কয়েক দফায় বিদেশ ভ্রমণ করে ব্যয় করেছেন সাড়ে ৭ কোটি টাকা। এর আগে ‘পুকুর পুনঃখনন ও ভূ–উপরিস্থ পানি উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচে ব্যবহার’ শীর্ষক প্রকল্পে ১৬ কর্মকর্তা বিদেশ সফর করে ব্যয় করেন কয়েক কোটি টাকা। দেশে কিভাবে পুকুর পুনঃখনন করা হবে সেজন্য বিদেশি পরামর্শকের পেছনে এই প্রকল্পে ব্যয় করা হয় ৪০ কোটি টাকা। এর আগে একটি উন্নতমানের ক্যামেরা কিনতে তিন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিদেশ সফর, নলকূপ খনন শিখতে একাধিক কর্মকর্তার বিদেশ সফর, ঘাস চাষ শিখতে সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩২ জন কর্মকর্তার বিদেশ সফর নিয়েও কম হাস্যরসের সৃষ্টি হয়নি। ২০২০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের অধীনে এক হাজার সরকারি কর্মকর্তাকে খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশে পাঠানোর জন্য ৫ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রস্তাব নিয়েও ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। খাদ্য গুদামের নির্মাণ কাঠামো দেখতে বিদেশ সফর করে ৬৫ জন কর্মকর্তার পেছনে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ের কাহিনি বা ফুল চাষ শিখতে বিদেশ গিয়ে সাড়ে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ের কাহিনিও আলোচনায় এসেছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে বারেবারে নিরুৎসাহিত করা হলেও নানা অজুহাতে প্রশিক্ষণের নামে অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফরের এই প্রবণতা রোধ করা যায়নি। বিদেশী ঋণ বা দেশীয় তহবিলে কোনও প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তার প্রজেক্ট প্রোফাইল তৈরির সময়ই প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের নামে বিদেশ ভ্রমণের একটি খাত রাখা হয়। আবার বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি, জাহাজ, টাগবোট বা অন্য কোনও বড় বাজেটের কেনাকাটা হলেও তাতে বিদেশ ভ্রমণটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, বিদেশ ভ্রমণটা হবে সরবরাহকারীর খরচে। কিন্তু এটা বলা হয় না, সরবরাহকারী পণ্যের মূল্যের সাথে এই খরচের দ্বিগুণ বা তারও বেশি যোগ করে আদায় করে নেন। অথবা তাকে সেভাবে পাইয়ে দেওয়া হয়। আমলাতন্ত্রে সৎ, দেশপ্রেমিকের সংখ্যা অনেক বেশি বলেই এ জাতীয় কর্মকাণ্ডগুলিতে আপত্তি জানানো হয়। অনেক অপ্রয়োজনীয় ‘প্রমোদ ভ্রমণ‘ বাতিলও করা হয়। দেখা যায় একসময় সৎ ও দেশপ্রেমিকরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন সুযোগসন্ধানীদের তৎপরতার কাছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেম ও মানবিক মূল্যবোধের উজ্জীবনই পারে এ ধরনের অরাজকতার অবসান ঘটাতে।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।