ও.রেল রিহাইড্রেশন সলিউশান বা থেরাপী। সংক্ষেপে ও.আর.এস বা ও.আর.টি। সাধারণের মাঝে পরিচিতি ওরস্যালাইন। এটি মানব শরীরের পানিশূন্যতাকে নিবারণ করে। আজকের লেখা ওরস্যালাইন ও এর আবিষ্কারককে নিয়ে। ও.আর.এস এর আবিষ্কাকারকের নাম ডা. দিলীপ মহালানবিশ। তিনি একজন চিকিৎসক ও গবেষক। ১৯৩৪ সালে বাংলাদেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। এককালে কিশোরগঞ্জ সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল। এই উপমহাদেশখ্যাত অনেক গুণীজনের জন্মস্থান যেমন শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়, অস্কার জয়ী সত্যজিত রায়, বিজ্ঞানী আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বসু এ অঞ্চলের সন্তান। ওরস্যালাইন যেটা মানুষের মুখে মুখে যার জনক ডা. দিলীপ মহালানবিশ যার আবিষ্কার (ও.আর.এস) ডায়রিয়া/কলেরা রোগীদের পানিশূন্যতাকে পূরণ করে লক্ষ রোগীর প্রাণ বাঁচায়। এমন উদ্ভাবক গবেষক সম্বন্ধে দেশবাসী আমরা অনেকেই অবগত নই। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার ডা. দিলীপ মহলানবিশ এ দেশেরই সন্তান। এদেশে তিনি বড় হয়েছেন। লিখাপড়া শিখেছেন। পরে ভারতে চলে যান। ভারতের পশ্চিম বঙ্গে এম,বি,বি,এস পাশ করেন ও পরে উচ্চ শিক্ষার্থে বিলেতে যান। পাশ করার পর পুনরায় ভারতে চলে আসেন। ষাটের দশকে বা তারও আগে তিনি দেখলেন গ্রামের পর গ্রাম বা শহরে ডায়রিয়ায়/কলেরায় সারা দেশে শত শত রোগী মারা যাচ্ছে। তিনি চিন্তা করলেন এর প্রাথমিক কারণ পানিশূন্যতা যাকে ডাক্তারী ভাষায় ডিহাইড্রেশন বলা হয়। তিনি দেখলেন ওয়াটারী স্টুলের সাথে সোডিয়াম, পটাশিয়াম এর মত ইলেকট্রলাইট শরীর থেকে বাহির হয়ে শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি করছে। তখন তিনি এই ও.আর.এস/ওর স্যালাইন আবিষ্কার করেন, যেটা ঘরে বসেও বানানো যায়। কোন ল্যাবরেটরির দরকার হয় না বা বিশেষ কোন ইনগ্রেডিয়েন্ট বা উপাদানের দরকার হয় না। রোগী পানিশূন্যতায় ছটফট করতে থাকে। পানি পান করার জন্য জিহ্বা বের করে দেয়। এমনকি খিঁচুনি হয়। তখন তিনি ল্যাব–টু–ল্যান্ড গবেষণায় এই ওরেল রিহাইড্রেশন সলিউশান তৈরী করলেন। সাধারণভাবে এটার পদ্ধতি হলো এক চিমটি লবণ, চায়ের চামচে পুরো এক চামচ চিনি অথবা মিঠা আধাকেজি ফুটন্তপানি ঠাণ্ডা করে তার সাথে মিশিয়ে বানানো যায়। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টা পর সেটা ফেলে দিতে হয়। পুনরায় বানাতে হয়। রোগী চাইলে বারবার খাওয়ানো যায়। এই পদ্ধতিটা এত সাধারণ যে গ্রামে গঞ্জে, অজ পাড়াগাঁয়ে দিন মজুরেরা, মা বোনেরা এটি বানিয়ে খাওয়াতে পারে। যদিও এর নাম ওরেল অর্থাৎ (মুখে), রিইহাইইড্রেশন (পানিশূন্যতা পূরণ) সলিউশন (তরল) বলা হয়। কিন্তু এটি আমাদের দেশে ওরস্যালাইন নামে সচরাচর প্রচলিত। পরিবারে যখন কারও ডায়রিয়া হলো, পেকেট ওরস্যালাইন হাতের কাছে না থাকলেও এটি বানিয়ে খাওয়াতে পারে। রোগীর বমির মধ্যেও এটি খাওয়ানো যায়। বেশ কয়েক দশক থেকে এটি পেকেট আকারে দেশের সর্বত্রই পাওয়া যায়। পাহাড়ে, সমতল ভূমিতে, জলযানে সর্বোপরি পরিবারে এটি এখন সংরক্ষিত থাকে। কারণ যেকোনও সময় ইমারজেন্সি কাজে লাগতে পারে। বর্তমান ও.আর.এস পেকেটে এই রূপে উপাদানগুলি থাকে– সোডিয়াম ক্লোরাইড–১.৩০ গ্রাম: পটাশিয়াম ০.৭৫ গ্রাম: ট্রাই সোডিয়াম সাইট্রেড ১.৪৫ গ্রাম: এন হাইড্রাস গ্লাকোজ ৬.৭৫ গ্রাম। ডাবের জলের থেকে এর উপকারিতা অনেক বেশি। যতই রোগী পান করবে ততই শক্তিবোধ হয়। সহজে রোগী দুর্বল হয় না। কারণ যে পানি শরীর থেকে চলে যাচ্ছে সেগুলি পূরণ হচ্ছে। এমন সহজ– কী চমৎকার আবিষ্কার। এই সলিউশনের মাধ্যমে রোগীর পানিশূন্যতা, ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স, কিডনী সমস্যা ঠিক রাখার চেষ্টা করা হয়। অনেকে মনে করেন ব্লাড প্রেশারের ও ডায়াবেটিস রোগীদের এটা খাওয়ানো যাবে না। এটা একেবারেই ঠিক নয়। তাতে রোগীর পানিশূন্যতা দেখা দিবে ও নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। সলিউশনে যে পরিমান উপাদান থাকে তা পরিমাণে কম থাকে এবং রোগী এটা সাময়িক ব্যবহার করে মাত্র। তাই অন্তত রেনেল বা কিডনী ফেইলিউর যাতে না হয় সেজন্য খাওয়ানো উচিত। জলের মত পায়খানায় ও বমিতে সোডিয়াম, পটাশিয়াম শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এটি প্রতিস্থাপনের জন্য ও.আর.এস খাওয়ানো অতি জরুরি। এতে গ্লুকোজের মাত্রা এতই কম যে ডায়াবেটিসের রোগীরাও খেতে পারবে। বিশেষ করে শিশুদের পানিশূন্যতার কারণে কিডনী ফেইলিউরের সম্ভাবনা থাকে যেটা মারাত্মক। রোগী কিছুটা ভালো হলেও চিকিৎসা বেশ কিছুদিন চালাতে হয়।
পত্রিকান্তরে বা টেলিভিশনে দেখবেন এই সমস্ত সিজনে কোন কোন শিশুরা নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় একসাথে আক্রান্ত হয়। হাসপাতালে জায়গা দিতে পারে না। তাই প্রথম থেকেই পরিমাণ মত ও.আর.এস খাওয়ানো ও একই সাথে মায়ের দুধ খাওয়ানো যায় এবং দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত। ও.আর.এস দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য খুবই সহায়ক। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এক কোটির অধিক শরণার্থী ভারতের পশ্চিম বঙ্গে ও অন্যত্র আশ্রয় নেয়। তখন শরণার্থী শিবিরে শিবিরে ডায়রিয়া, কলেরা ও অন্যান্য সংক্রম রোগ মহামারী হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে। রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী আই,ভি (শিরায়) স্যালাইনের সরবরাহ ছিল খুবই অপ্রতুল। পানিশূন্যতায় বিপুল সংখ্যক রোগী মারা যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে ডা. দিলীপ মহলানবিশের যুগান্তকারী আবিষ্কার ওরস্যালাইন লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর প্রাণ বাঁিচয়েছিল। সেই সময় জরুরি ভিত্তিতে ওরস্যালাইন ব্যবহার করে ৩০% রোগীকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। ভাবলে অবাক লাগে! মানুষ বলে না– টুটকা ওষুধেও মহৎ কাজ হয়। ডায়রিয়া হলে আশেপাশের লোকেরা বলে উঠে ওরস্যালাইন খাওয়াও। এখানে সুবিধা একটাই ঘরে বসে বানানো যায়। ৩য় বিশ্বে যেখানে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ এ ধরনের উদ্ভাবক অবিস্মরণীয়।
ও.আ.এস বা ওরেল রিহাড্রেশন সলিউশনকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয় থাইল্যান্ড সরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা এটাকে স্বীকৃতি দিয়েছে অনেক আগে। পশ্চিম দুনিয়া এটি উদ্ভাবনের দশ বৎসর পর স্বীকৃতি দিয়েছিল।
ডাক্তার গবেষক দিলীপ মহলানবিশ এর ক্ষুদ্র অথচ যুগান্তকারী আবিষ্কার যুগ যুগ ধরে মানব কল্যাণে ব্যবহৃত হবে এবং এই আবিষ্কারের মাধ্যমে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।
লেখক: প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশে রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।