জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মঙ্গলবার পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন সোসাইটির উদ্যোগে আয়োজিত নাগরিক সভায় বক্তারা বলেছেন, বায়ু দূষণের কারণে প্রতিবছর দেশে লক্ষাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রতি ঘনমিটার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বালু কণার আদর্শ মান ২.৫ (পিএম ২.৫)। অথচ বাংলাদেশে প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম থেকে বাড়িয়ে ৩৫ মাইক্রোগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটি ১০ মাইক্রোগ্রাম থেকে কমিয়ে ৫ মাইক্রোগ্রাম করেছে। নাগরিকদের প্রতি উদাসীনতা বর্তমান রাষ্ট্রের একটা চরিত্র। বক্তারা বলেন, আমাদের দেশে বায়ু ও পরিবেশ নিয়ে প্রায় ২০০টির মতো আইন আছে। কিন্তু এগুলোর প্রয়োগ নেই। দূষণ কমানোর জন্য আদালত স্থাপন করা হয়েছে। গত ২০ বছরে বায়ু দূষণ নিয়ে যত মামলা হয়েছে, সেখানে মাত্র একজনের সাজা হয়েছে। মামলা যেগুলো হয়েছে সেগুলো বছরের পর বছর চলছে, বিচারক নেই। এ মামলাতে লোকজন ভয় পাচ্ছে না। সরকার তার দায় এড়াচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আমরা অনেক পেছনে আছি। তাঁরা বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে– রাষ্ট্র বর্তমান এবং আগামী দিনের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ করবে। আমরা তা নিজেদের জন্য তো করতে পারছিই না বরং আগামী দিনের নাগরিকদের জন্যও পরিবেশ নষ্ট করে ফেলছি। অনেক শিশু বায়ু দূষণের কারণে শ্বাসকষ্টে ভুগছে।’
আসলে বায়ুদূষণ এখন বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায় বলে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বায়ু দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব অনেক। দূষিত বায়ুতে আমাদের নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হয়। বায়ু দূষণের ফলে সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা ও সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর। দূষিত বায়ু আমাদের শরীরে নানা রকম রোগ সৃষ্টি করে থাকে। বায়ু দূষণের কারণে হাঁপানি, ক্যান্সার, হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যাসহ বহুরোগ হয়। বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। এক পরিসংখ্যান বলছে গত বছর পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪০ হাজার শিশুর মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণ এর ফলে যে শুধুমাত্র আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি তা নই। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বায়ু দূষণের ফলে ওজন স্তর পাতলা হচ্ছে যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে ভয়াবহ দাবানল, অসময়ে বন্যা, জলোচ্ছাস সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বায়ুদূষণ রোধের মূল দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। তারা বায়ু, পানিসহ পরিবেশগত নানা দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তাদের খুব কার্যকর পদক্ষেপ আমরা দেখি না যার ফলেই একটি দেশ বারবার দূষণে শীর্ষে।
তাঁরা বলেন, বর্তমানে বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত জনজীবনের চিত্র গণমাধ্যম এবং পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হলেও এটা এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। প্রশাসন এবং জনগণ কেউই সচেতন নয়। বায়ুদূষণ রোধে জনসচেতনতা খুবই জরুরি। দূষণ রোধ করার জন্যে নগরায়ণে সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার। শিল্প–কারখানা থেকে যেন বায়ুদূষণ না হয় তাই পরিবেশবান্ধব শিল্প–কারখানা নির্মাণ করতে হবে। নির্বিচারে গাছকাটা বন্ধ করে বনায়ন করতে হবে। ঢাকার রাস্তায় নিয়মিত পানি ছিটাতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সবার আগে দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করে দূষণ কমিয়ে আনতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সমন্বয়হীনভাবে রাস্তার খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। সেবাদানকারী সংস্থার সংস্কার কাজে সমন্বয় এনে স্বল্প সময়ে সংস্কার শেষ করতে হবে। দূষণরোধ করার জন্যে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা যেকোনো দূষণ রোধ করতে পারে কিন্ত শুধুমাত্র সচেতন হয়ে এখন দূষণ রোধ করা সম্ভব না। পরপর চারবার বায়ুদূষণে শীর্ষে রয়েছি আমরা, দূষণরোধে এখনই যদি কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তবে অনেক দেরি হয়ে যাবে। বায়ুদূষণ রোধ করার জন্যে এখনই সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে হবে। পরিবেশ সংক্রান্ত যেসব আইন আছে, সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। রাস্তাঘাট ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দূর করতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দূষণরোধ করতে স্থানীয় প্রশাসন, বেসরকারি সংস্থা, ব্যবসায়ী পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।