এক সময়ে গ্রাম–বাংলার ঘরে ঘরে পুঁথি পাঠের আসর বসত। তখনকারদিনে মানুষের মাঝে সততা শ্রদ্ধা ও সদ্ভাব ছিল, এখনকার মত মানুষের জীবন এতো জটিল ও সমস্যা সংকুল ছিল না। জাতি ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ নির্ভাবনায় জীবন যাপন করত। সর্বত্র সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় ছিল। লোকসংখ্যা ছিল খুবই কম। ভোগবিলাসের জন্য মানুষকে এখনকার মত এতো পরিশ্রম করতে দেখা যেত না। মানুষের জান–মালের সম্মান আব্রুর নিরাপত্তার নিশ্চিয়তা ছিল। বাঙালি কৃষকেরা বছরের কয়েকমাস কৃষি কাজে ক্ষেত খামারে কাটিয়ে দিয়ে বছরের বাকি সময় সুখে–শান্তিতে কাটিয়ে দিত। তখনকার দিনে মানুষের জীবনে অবসর ছিল প্রচুর। এখনকার মত বিনোদনের এতটা ক্ষেত্র প্রচলন ছিলনা। মানুষের বিনোদনের একমাত্র অবলম্বন ছিল পুঁথিপাঠ, পালাগান, যাত্রা, জারি, সারি গানের আসর। পুঁথিপাঠ ছাড়া কোনো বিয়ে সাদী কিংবা উৎসব আয়োজনের কল্পনা করা যেত না। দিনের কাজ–কর্ম ক্লান্তির শেষে, ঘরে ঘরে বসত পুথিঁর আসর। সুর করে পাঠ হত ইউচুপ–জুলেখা, লাইলী–মজনু হাতেমতাই, কাছাছোল আম্বিয়া, জঙ্গনামাসহ বিভিন্ন পুঁথি। সঙ্গে থাকত পান–সিগারেট আর চা পাক্কনের ব্যবস্থা।গৃহস্ত মানুষ রাত জেগে শুনত পুঁথির অপুর্ব কেচ্ছা কাহিনি। প্রেম বিরহ আনন্দ বেদনার ভাব রসে মুগ্ধ হয়ে যেত শ্রোতারা। অপুর্ব বর্ণনা কৌশলে পুঁথির সে সব কল্প–কাহিনি শ্রোতার কাছে অবাস্তব বলে মনে হত না।
প্রাচীন পুঁথি সাহিত্য বাংলাসাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পল্লী বাংলার পুঁথি সাহিত্য অতীতের সাথে বর্তমানের সেতুবন্ধন প্রভাব অপরিসীম। শ্রদ্ধেয় আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ দেখিয়েছেন যে, আমাদের পুঁথি সাহিত্যের ভাণ্ডার কত বিরাট ও বিচিত্র। দীর্ঘ কাল যাবৎ এই পুঁথি সাহিত্য পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এক শ্রেণির উঠতি বাঙালিদের কাছে বটতলার পুঁথি নামে তুচ্ছ ও তাচ্ছিল্যের বস্তু ছিল। পাশ্চাত্য ও আধুনিক নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতির প্রভাবে পুঁথি সাহিত্যের সে জৌলুশ আজ আর নেই। তবে আশার কথা পুঁথি সাহিত্য আর অবহেলিত ও অনাদৃত নয়। বর্তমানে অনেকেই প্রাচীন পুঁথি সাহিত্য থেকে নানা রকম ‘মিথ’ও উপাদান সংগ্রহ করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধিকরণ ও জাতীয় ইতিহাস বিনির্মাণে সচেষ্ট। ড. সাকলায়েন বলেন, বাঙালি মুসলমানদের ভাষায় যদি কোন প্রামাণ্য দলিল থেকে থাকে, তাহলো সেটা আমাদের বিরাট পুঁথি সাহিত্য। পুঁথি সাহিত্যের উৎপত্তি সম্পর্কে আবদুল গফুর ছিদ্দিকী অনুসন্ধান বিশারদ বলেন, তৎকালীন বাঙালি মুসলিম জাতির দৈন্য দশা ও অধঃপতনের হাত থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উৎপত্তির কারণ। শহরের তে–মনিতে না হোক, এখনও অন্তত গ্রাম–বাংলার হাটখোলা আর বটতলার চাষা–ভূষা ব্রাত্য জনগোষ্ঠীর কাছে পুঁথির আবেদন একেবারে নিঃশেষিত হয়ে যায়নি।