যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির মিশন ডিরেক্টর রিড জে অ্যাচিলম্যান বলেছেন, ব্যবসা–বাণিজ্যে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ। বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও জ্বালানির মতো খাতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বড় বাধা দুর্নীতি। সেবা পেতে বেশি দুর্নীতি হয়। কিন্তু প্রতিযোগী দেশ হিসাবে এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে ভিয়েতনাম। দুর্নীতি রোধ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনসচেতনতা সৃষ্টি জরুরি। অ্যাচিলম্যান বলেন, বাংলাদেশের সম্ভাবনা বিশাল। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বেসরকারি খাতকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি বলেন, সম্ভাবনার তুলনায় দেশি–বিদেশি বিনিয়োগ খুবই কম। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের ব্যবসা–বাণিজ্য পরিচালনায় প্রয়োজনীয় সেবা পেতে দুর্নীতির শিকার হতে হয়। এ কারণেই এ দেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা শতভাগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অথচ দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, জ্বালানির মতো বেশ কিছু খাতে এফডিআই বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নিজ অবস্থান করে নিয়েছে। ফলে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিশেষ ইউটিলিটি সার্ভিস দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিনিয়োগ বান্ধব আইন বা নীতিমালা করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের প্রতিযোগিতামূলক প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ জ্বালানি অবকাঠামোর বিস্তার করা হয়েছে। বিভিন্ন সেবা–পরিসেবা প্রদানে ওয়ান– স্টপ সার্ভিসও চালু করা হয়েছে। এ অবস্থায় দুর্নীতি দূরীকরণের বিষয়টি গুরুত্ব বহন করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য গত বছর শুরু হয়েছিল অস্থিতিশীলতায়। কোভিড–পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে জ্বালানি পণ্যের বাজারদর ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যেই গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের আলোড়ন তৈরি করে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের সূত্রপাত। এ আলোড়নের আঘাত এসে পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। এরই প্রভাব পড়েছে বিদেশী বিনিয়োগের ওপরও।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রকাশিত বিনিয়োগের পরিবেশ সংক্রান্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সীমিত অর্থায়নের সুযোগের মতো বেশ কিছু কারণ বড় বাধা সৃষ্টি করছে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ সরকার বলছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকলেও সেগুলো সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে এবং বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলেন, বিদ্যুৎ, গ্যাস বা পানিসহ যেসব সেবা পাওয়ার কথা, সেগুলো সরবরাহের ক্ষেত্রে যে সমস্যা আছে, তার সুরাহা হলে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে নিঃসন্দেহে। তাঁরা বলেন, ‘নানা বাধা পেরিয়ে অনেক বিদেশী বিনিয়োগকারী নিবন্ধন করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের কম সংখ্যকই বিনিয়োগ করে থাকেন। বলা যায়, বাংলাদেশে যা নিবন্ধন হয়, তার এক তৃতীয়াংশও কার্যকরভাবে বিদেশী বিনিয়োগ হয় না।’ এ ক্ষেত্রে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অর্থনৈতিক নীতিসমূহের ক্ষেত্রে সরকার দ্রুত সুনির্দিষ্ট সংস্কার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে সবার জন্য উন্মুক্ত বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন করছে, যেখানে সরকারের ভূমিকা অনুঘটকের, নিয়ন্ত্রকের নয়। নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধকে ন্যূনতম একটি পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে; সরকার সুষম গতিতে বাণিজ্য ক্ষেত্রে উদারীকরণ করেছে; শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা, যৌক্তিক শুল্ক নির্ধারণ এবং রপ্তানি সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন সাধন করেছে; শিল্পহার কাঠামো ও আমদানিনীতির বিভিন্ন দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য এই দেশে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ রয়েছে। যেমন: অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য, ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদন, বস্ত্র ও চামড়া, স্বয়ংস্ক্রিয় ও হালকা প্রকৌশল, কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং তেল, গ্যাস ও সমুদ্র অর্থনীতি।
তবে অ্যাচিলম্যানের মতো কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। তারপরে রয়েছে যথাক্রমে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে আইনের দ্রুত প্রয়োগের অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও মাত্রাতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ, দুর্বল অবকাঠামো ও গ্যাস–বিদ্যুৎ সংকট, জমির অভাব ও ক্রয়ে জটিলতা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অঙ্কের ঋণ জোগানে অক্ষমতা এবং স্থানীয়দের সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের যোগসূত্র ও সমন্বয়ের অভাব। এর বাইরেও রয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হলে আগে দেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। দেশী বিনিয়োগকারীদের দেখে বিদেশীরা এগিয়ে আসবেন। তাদের মনে আস্থার সঞ্চার করতে হলে বাংলাদেশীদের স্বদেশে বিনিয়োগের উদাহরণ তুলে ধরতে হবে।