প্রায়োগিক অর্থে মানবতার সার্বজনীন উপাদান তথা সত্য, সুন্দর, কল্যাণ ও আনন্দ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ধার্মিকতা–অসামপ্রদায়িক স্বর্গীয় সত্তায় মুক্ত প্রেমবাদের বীজ বপনকারী এবং খোদার নৈকট্য লাভের শর্ত হিসেবে সামগ্রিক আত্মিক ও আর্থ–সামাজিক মঙ্গল সাধনের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত যুগোপযোগী দর্শনের সূচনাকারী হযরত গাউছুল আজম শাহ্ সুফী মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ) মাইজভাণ্ডারী স্মরণে দু’টো কথা বলার জন্যই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। বস্তুতঃপক্ষে পবিত্র কোরআন, হাদিস ও সুন্নাহ্’র আলোকে ইহকাল এবং পরকালের জীবন ব্যবস্থার প্রতি অবিচল আস্থা, ধারণ ও অনুশীলনে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য যে প্রাগঢ় প্রেমের নিবেদন ও বন্ধন স্থাপন, জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তার সার্বিক প্রতিফলন ঘটিয়ে হযরত গাউছুল আজম (কঃ) মাইজভাণ্ডারী মানব মুক্তির পবিত্র সনদ রচনা করে গেছেন। যুক্তি ও অসামান্য বিজ্ঞানসম্মত ধ্যান–ধারণার সুচারু সম্মিলনে দেহ ও আত্মার উন্নয়নের যে মননশীল পরিক্রমা, নির্লোভ ও নির্মোহ জীবন যাত্রার কঠিন শিক্ষা এবং আরাধনার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত জাগতিক চর্চার অনুপম কৌশলে হযরত গাউছুল আজম (কঃ) মাইজভান্ডারী’র আধ্যাত্মিকতা পবিত্র ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ–সূফীবাদকে এক গৌরবোজ্জ্বল অবস্থানে উন্নীত করেছে।
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সঃ)’র জীবনাদর্শকে ভিত্তি করে ধর্ম–কর্ম ও জীবন নির্বাহে আত্ম–নির্ভরশীল হওয়া (ফানা আনিল ফালাখ), অনর্থক কাজ–কর্ম, কথা–বার্তা পরিহার করা (ফানা আনিল হাওয়া) ও খোদার ইচ্ছা শক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া (ফানা আনিল এরেদা)-এই তিন মহৎ বৈশিষ্ট্যের সমাহারকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রধান নিয়ামক চিহ্নিত করে আত্ম–সংযম, আত্ম–সমালোচনা ও নির্বিলাস জীবনের গতিময়তায় সর্বোপরি আত্ম–পরিপূর্ণতার পবিত্র দিগ্–দর্শন দিয়ে গেছেন এই মহান অলি। এখানেই তাঁর বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। বিশ্বনবীর ওফাত মোবারকের প্রায় পাঁচশত বছর পরে যখন পবিত্র ইসলাম ধর্ম বহুবিধ মতবাদ ও পন্থায় বিভ্রান্ত এবং রসূলের (সঃ) আদর্শ বিচ্যুত এক ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অসৎ জ্ঞান ভিত্তিক ধর্ম চর্চা পবিত্র ইসলামকে সংকটাপন্ন করে তুলেছিল, তখনই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র ইসলামকে শাশ্বত ধারায় জাগ্রত করার জন্য ৪৭০ হিজরীর পবিত্র রমজান মাসে ইরান দেশের অন্তর্গত জিলান নগরে হযরত গাউছুল আজম মহিউদ্দিন শাহ সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী (রাঃ) কে এই দুনিয়াতে পাঠান। অস্বাভাবিকভাবে ষাট বছর বয়স্ক মহিলার গর্ভে ধারণ করিয়ে জন্মের আগ থেকেই তিনি আল্লাহ পাকের মহিমা প্রকাশ সূচনা করলেন।
প্রায় সাড়ে সাতশত বৎসরের অধিককাল পর আবার যখন ইসলামের আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও জগতের যথার্থ প্রচার–প্রসারে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক বন্ধাত্ব নেমে আসতে শুরু করে এবং প্রেমবিহীন এক কৃত্রিম খোদা প্রীতির আড়ালে ভোগবাদের ভঙ্গুর অবয়বের বিস্তার শুরু করে, তখনই এই ধরাধামে ১২৪৪ হিজরী বা ইংরেজী ১৮২৬ সালে হযরত গাউছুল আজম (কঃ) মাইজভাণ্ডারীর আবির্ভাব ঘটে। জন্মের তিন দিন পরই যখন শিশু গাউছুল আজম এর নাম রাখার আয়োজন চলছিল তখন তাঁর পিতা স্বপ্ন দেখলেন যে, প্রাণপ্রিয় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) তাঁকে বলছেন, “হে মতিউল্লাহ্! তোমার ঘরে আমার প্রিয় মাহবুব আসিয়াছে। আমি তাঁর নাম আমার “আহমদ” নামে আল্লাহ যুক্ত করিয়া আহমদ উল্লাহ রাখিলাম”। এভাবেই জন্মের শুরুতেই অভিনব বেলায়েতী মহিমায় হযরত গাউছুল আজম আলোকিত বিশ্বের অনুসন্ধানে অনন্ত জীবনযাত্রায় অভিষিক্ত হলেন। তাঁর বয়স যখন দু’বছর, তখনই স্বেচ্ছায় মাতৃ–দুগ্ধ পান বন্ধ করে এক অর্পূব কেরামতিতে আল্লাহ পাক বর্ণিত কোরআনের আদর্শ পালন শুরু করলেন। বাল্যকালে বাংলা ও আরবী শিক্ষা নিতে গিয়ে পাঠশালায় এক অনুপম চরিত্রের অধিকারী হলেন। সকলের সাথে সমপ্রীতি, গুরুভক্তি, পাঠ্যক্রমে মনোযোগী, মিতভাষী চরিত্রের অধিকারী হয়ে এক গুণী ব্যক্তিত্বের প্রকাশ অব্যাহত রাখলেন। সাত বৎসর বয়সে নামাজ শিখে জামাতে নামাজ আদায় করার জন্য উদ্বিগ্ন থাকতেন। লেখাপড়ায় উনি সব সময় প্রথম স্থান অধিকার করতেন। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলিকাতায় গমন করে ১২৬০ হিজরীতে আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন শুরু করেন। তিনি রাতের অধিকাংশ সময় আল্লাহর ইবাদতে ও ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। ১২৬৮ হিজরীতে হাদিস, তফসীর, ফিকহ্, হেকমত, বালাগাত, উছুল, আকায়েদ, ফিলছফা ও ফরায়েজ যাবতীয় শাস্ত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করে আরবী, উর্দু, ফার্সী ভাষায় পারদর্শী হয়ে কলকাতার মাদ্রাসায় শেষ পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এক্ষেত্রে হযরত গাউছুল আজম মাহবুবে সোবহানী গাউসে সমদানী হযরত সাইয়্যেদুনা আবদুল কাদের জিলানী (রাঃ) জ্ঞান অর্জনে বুৎপত্তি লাভের সঙ্গে হযরত গাউছুল আজম (কঃ) মাইজভাণ্ডারীর জ্ঞান অর্জন ও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির অপূর্ব মিল খুঁজে পাওয়া যায়। হযরত গাউছূল আজম মাইজভাণ্ডারীও শিক্ষার জন্য শুধু কলিকাতায় গমন করেননি, সেখানে তিনি তাঁর জীবন যাত্রার কঠিন অনুশীলনগুলো রপ্ত করেছেন। তিনি আল্লাহ ছাড়া কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে এমনকি জায়গীরও না থেকে নিজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সাধনা অব্যাহত রেখেছিলেন। বাল্যকাল থেকে তিনি ওয়াজ–নসিহত, মিলাদ ও দরূদ শরীফ পাঠ এবং অলি কেরামদের মাজার জেয়ারত ভালবাসতেন।
১২৬৯ হিজরী সনে যশোরে কাজী পদে এবং বৎসর খানেক পরে তা ত্যাগ করে মাদ্রাসায় প্রধান মোদারেছ হিসেবে যোগদান হযরত গাউছুল আজম (কঃ) মাইজভাণ্ডারীর পেশাগত জীবনের সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে। পরবর্তীতে পবিত্র বাগদাদ শরীফের হযরত গাউছূল আজম (রাঃ) বংশধর এবং কাদেরীয়া ত্বরীকত খেলাফত প্রাপ্ত গাউছে কাওনাইন শেখ সৈয়দ আবু শাহমা মোহাম্মদ সালেহ কাদেরী লাহোরী ও তাঁর অগ্রজ চির কুমার শাহ সৈয়দ দেলওয়ার আলী পাকবাজ এর সংস্পর্শে এসে হযরত গাউছুল আজম আহমদ উল্লাহ (কঃ) মাইজভান্ডারী ফয়েজ ও কামালিয়াত প্রাপ্ত হন। হযরত গাউছুল আজম (কঃ) মাইজভাণ্ডারী হযরত আবদুল কাদের জিলানীর (রঃ) মতো কঠিন দারিদ্র্যের কষাঘাতে জীবন সংগ্রামে উত্তীর্ণ এক মহাপুরুষ। হযরত গাউছুল আজম (রঃ) নিজের অভাব অনটনের কথা কাহারো কাছে প্রকাশ করতেন না। অভাবের সময় এমনকি অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাঠানোর সময়েও কাহারোও নিকট সাহায্য প্রার্থনা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। ক্ষুধার জ্বালায় অসহ্য হয়ে গাছের পাতা ও ফলমুল খেয়েও ক্ষুধা নিবারণ করতেন। এতদসত্ত্বেও বিদ্যা–শিক্ষা, রিযাজত ও ইবাদতে বিন্দুমাত্র কখনও ব্যাঘাত ঘটতে দেননি। একই রকম ঘটনা হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর (কঃ) জীবনেও আমরা দেখতে পাই। অনাহার–অনিদ্রায় তাঁর দীর্ঘকাল অতিক্রমের ইতিহাস ভক্তকূলের সবাই অবগত আছেন। কথিত আছে যে, এরকমই অভাবের সময় ঘরে জীর্ণ শীর্ণ ছাউনি বদলানোর অতীব প্রয়োজন হয়ে পড়লে একদিন ঘরে সামান্যতম খাবারের বন্দোবস্ত না থাকা সত্ত্বেও ছাউনি দিতে আসা কামলাদের দুপুরের খাবার আয়োজনের জন্য তাঁর আম্মাজানকে তাগিদ দিতে থাকেন। কিন্তু অকস্মাৎ ঠিক আহারের পূর্ব মুহূর্তে অলৌকিকভাবে খাবারের আয়োজন অর্থাৎ অজানা কোন এক জায়গা থেকে অত্যন্ত উঁচুমানের খাবার আসার ঘটনা হযরত গাউছুল আজম (কঃ) মাইজভাণ্ডারীর বেলায়েত ও কেরামতের প্রথম প্রকাশ ঘটায়। এ ধরনের বিভিন্ন কেরামত ও বেলায়েতী জজবা হযরত আহমদ উল্লাহ্(কঃ) মাইজভান্ডারী আগমন ও অবস্থান সম্পর্কে অনেক অলি কেরামের সুস্পষ্ট ইঙ্গিতকে বাস্তবে রূপদান করে।
হযরত গাউছুল আজম (কঃ) মাইজভাণ্ডারী নিজেই ঘোষণা করেন– “রসুলুল্লাহ (সঃ) দুই টুপির একটি আমার মাথায় এবং অপরটি পীরানে পীর ছাহেবের মাথায় পরিয়ে দিয়েছেন। আমার নাম পীরানে পীর ছাহেবের সাথে সোনালী অক্ষরে লেখা ছিল। আমি এবং আমার ভাই পীরানে পীর ছাহেব একদা কা’বা শরীফে ঢুকে রসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বক্ষস্থলে ডুব দিলাম। দেখলাম এর অনন্ত দরিয়া”। হযরত গাউছূল আজম (কঃ) মাইজভান্ডারী এর বর্ণনায় স্পষ্ট যে, হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রঃ) এবং তিনি ছাড়া আর কেউ গাউছুল আজম দাবী করেননি। এ বক্তব্য অবশ্যই তাঁর আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বকে দায়িত্বের সাথে প্রতিষ্ঠা করে যা আমাদের জ্ঞান বা ধারণা বহির্ভূত। এ প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা মোহাম্মদ জালালুদ্দিন রুমীর (রঃ) একটি বাণী প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “দরবেশীর কাজ তোমাদের জ্ঞানের বাহিরে। তোমরা ফকির দরবেশদিগকে কখনও ঘৃণা বা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখোনা”। হযরত গাউছূল আজম (কঃ) মাইজভাণ্ডারী প্রবর্তিত মাইজভাণ্ডারী দর্শনের আদর্শ উদ্দেশ্যকে ধারণ করে অসংখ্য সুফী, অলি–দরবেশ বহুকাল ধরে এ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে হেদায়েত করে আসছেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, হযরত গাউছূল আজম মাইজভাণ্ডারী (কঃ)’র ওফাত মোবারকের পর তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী হযরত মাওলানা গোলামুর রহমান বাবাভাণ্ডারী (রঃ), অছিয়ে গাউছুল আজম হযরত দেলওয়ার হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (রঃ) ও বিশ্ব অলি শাহানশাহ হযরত জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (রঃ) তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধার যৌক্তিক সমন্বয় ঘটিয়ে এবং বেলায়েতের শক্তিতে আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতায় মাইজভাণ্ডারী দর্শনকে জাতি–ধর্ম–বর্ণ–অঞ্চল ইত্যাদি নির্বিশেষে সকল মুক্তিকামী মানুষের জন্য এক অনন্যসাধারণ জীবন দর্শন হিসেবে প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন।
এ মহান সর্বজনীন মানবতাবাদী দর্শনের তীর্থভূমি পবিত্র মাইজভান্ডার দরবার শরীফ সম্পর্কে শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (কঃ) সঠিক ভাবে বলেছেন, “গধরুনযধহফধৎ ঝযধৎরভ রং ধহ ড়পবধহ. উড় হড়ঃ ঃযরহশ রঃ ড়ঃযবৎরিংব। বর্তমানে এটি স্বীকৃত ও সর্বজনবিদিত যে, মহাসাগর যেমন সকল নদী, সাগর ইত্যাদির সাবলীল স্রোতধারার অনাবিল মিলনকেন্দ্র, মাইজভান্ডার দরবার শরীফও সকল ত্বরিকা ও মতামতকে একই লক্ষ্যবিন্দুতে পরিণত করেছে। এই মহান দর্শনের প্রণেতা হযরত গাউছুল আজম (কঃ) মাইজভান্ডারী যেমন ১ মাঘ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ৭৯ বছর বয়সে ১৩১৩ বঙ্গাব্দ (১৯০৬ সাল) তেমনি মাঘ মাসের ১০ তারিখে এই ধরাধাম ত্যাগ করেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়