কোনো পণ্যের সংকট না থাকলেও কিছু মতলববাজ মধ্যস্বত্বভোগী দাম বাড়াচ্ছে, কারসাজি করছে। কথিত সেই শ্রেণির কৃত্রিম সংকটের কারণে মাঝে মধ্যে ‘বিপদে পড়ার’ মতো অবস্থা তৈরি হয়, যাদের বিরুদ্ধে আবারও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে।
নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি থামাতে নতুন সরকারের পাঁচ মন্ত্রীর বৈঠকের পর গতকাল রোববার এমন হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। রোজায় পর্যাপ্ত পণ্য মজুদ থাকা এবং দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আশ্বাসও দেওয়া হয় তাদের পক্ষ থেকে। এদিন সচিবালয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করেন তারা। বৈঠক শেষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান এসব মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান। তবে এর কোনো দিনক্ষণ বলেননি তিনি। খবর বিডিনিউজের।
টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং বিশ্ববাজারে রপ্তানি বাড়ানোকে প্রধান কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে মূল্যস্ফীতি, গ্যাস–বিদ্যুতের সংকট, ডলার সংকট ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে এই দুটি লক্ষ্যই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশের বাজারে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। গত তিন মাস ধরে রপ্তানি আয়ও নিম্নমুখী। সরকারি হিসাবে প্রতিকেজি চাল এখন ৫২ টাকা থেকে ৭৫ টাকার মধ্যে। প্রতিকেজি আটা ৬৫ টাকা, ময়দা ৭৫ টাকা, মসুর ডাল ১১০ থেকে ১৪০ টাকা, মুগডাল ১৬০ টাকা, অ্যাংকর ডাল ৮০ টাকা ও ছোলা ৯৫ টাকা। নিজেদের উৎপাদিত আলুর কেজি এখন ৫০ টাকার বেশি, যা ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ। মাছ, মাংস, ডিম, শাক–সবজি সব পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী। এমন পরিস্থিতিতে রোববার বিকালে সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের উপায় খুঁজতে বৈঠকে বসেন নতুন সরকারের পাঁচজন মন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে বৈঠকে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান ও বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু অংশ নেন। এতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ সংশ্লিষ্ট সচিবরা।
প্রায় দুই ঘণ্টার এ বৈঠকের পর মন্ত্রীরা সাংবাদিকদের সামনে আসেন। তারা দ্রব্যমূল্য, মজুদ পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা তো পদক্ষেপ নিচ্ছি। আপনারা দেখেন, ইতোমধ্যেই দাম কমেছে, আরও কমবে। চাল নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। বাজারে আলুর দাম বেশি, সাধারণ কৃষক লাভবান হচ্ছেন না। লাভ পাচ্ছেন মধ্যস্বত্তভোগীরা। সরকার কী করছে? এমন প্রশ্নে মাহমুদ আলী বলেন, ব্যবসায়ীদের ট্রাকগুলো কৃষকের ক্ষেতে চলে যাচ্ছে। নিজেদের লোক দিয়ে তুলে নিয়ে আসছে। আলুর দামে কৃষকের ডেফিনেটলি লাভ হচ্ছে। ‘ভোগ্যপণ্যে মনোপলি ব্যবসা হচ্ছে। বাজারে প্রতিযোগিতা নেই,’ এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা অ্যাকশনে যাচ্ছি। কতদিনের মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনবেন–সেইভাবে কখনই বলা সম্ভব না। এটা ফ্রি মার্কেট।
‘চালের দাম ১০ টাকা বেড়ে ১ টাকা কমেছে। তাহলে আমদানির মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন কিনা?’-এ প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ ধরনের উদ্যোগ নিশ্চয় থাকবে। দরকার হলে আমদানি করতে হবে। কিন্তু এখনও তো ওই রকম কিছু হয়নি।
সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান বলেন, পাঁচ মন্ত্রণালয় বলেন, আর আন্তঃমন্ত্রণালয় বলেন। এই বৈঠকের অর্থ হচ্ছে সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যাদি মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং তাদের যাতে সহজলভ্য হয় সেই ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, বিভিন্ন কারসাজিতে কিছু কিছু জিনিসের দামে ব্যাত্যয় ঘটেছে। সেই ব্যাপারে যেন আমরা পদক্ষেপ নিতে পারি সে ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। তবে মোদ্দা কথা হল বাজারে কোনো নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির শর্টেজ নাই। কিন্তু কিছু মতলবাজ মধ্যস্বত্তভোগী আছে, তারা কারসাজি করে। সেই শ্রেণির কৃত্রিম সংকটের কারণে আমরা মাঝে মধ্যে এরকম বিপদে পড়ি। এসব বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, আশা করি আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব।
বাজারে সিন্ডিকেট আছে, মজুদদারি আছে। কিন্তু তাদের বের করতে পারছেন না কেন? ১৫ বছর ধরেই শুনছি এসব কথা–এমন প্রশ্নে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বলেন, বের করতে পারি নাই তা নয়। বের তো অবশ্যই করছি। পূর্ণাঙ্গ বের করার ব্যাপারটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমরা সেই ব্যাপারগুলোই আলোচনা করছি। চিহ্নিতকরণ ব্যাপারটা যখন সুনির্দিষ্ট করা যাবে তখনই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের ছাড়পত্র বন্ধ করা হবে।
বাজারে পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে এবং ঘাটতি নেই দাবি করে আব্দুর রহমান বলেন, সমস্ত পরিসংখ্যান আছে, কোনো কিছুতে শর্টেজ নেই। সেই হিসাব্টা আছে। আমার মনে হয় যে, টেকনিক্যাল রিজনে সেই পরিসংখ্যানটা বিস্তারিত আপনাদের কাছে দিতে চাই না। এ সময় সাংবাদিকদের একজন প্রশ্ন করেন মধ্যস্বত্বভোগীদের যদি চিহ্নিত করতে নাই পারলেন, তাহলে কী করে বুঝলেন যে মধ্যস্বত্বভোগী আছে? এর উত্তরে মন্ত্রী বলেন, অনুমান নির্ভর এক জিনিস, সন্দেহ পোষণ করা এক জিনিস, কাউকে সন্দেহের তালিকায় আনা এক জিনিস, আর সেইটাকে সুস্পষ্ট করা আরেক জিনিস। এবং সেই সুস্পষ্টকরণ সম্পন্ন হলেই চিহ্নিত করা যাবে যে, দিজ আর দি পিপল আর ইনভলব ইন অল দিজ এনমালিজ। সুতরাং একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
ডলার সংকটের মধ্যে সুচারুভাবে এলসি খোলা যাবে কিনা–জানতে চাইলে বিফ্রিংয়ের সময় উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর রউফ তালুকদার রমযানের আট পণ্য আমদানিতে এবার জানুয়ারিতে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি এলসি খোলার তথ্য দেন। তিনি বলেন, সুতরাং এলসি ওপেন করার যে সমস্যার কথা আপনারা বলছেন সেটা ঠিক না। এখন এই পণ্যগুলো সময়মত দেশে আসবে বলে আশা করছি। এখন মধ্যস্বত্বভোগীর সমস্যা না থাকলে দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই এবং পণ্যের কোনো ঘাটতি হবে না।