চট্টগ্রামে চলছে তীব্র গ্যাস সংকট। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী। দিনের পর দিন একটানা চলছে এই দুর্ভোগ। প্রায় দুই মাস ধরে চলা এই সংকটে বিপর্যস্ত নগরবাসী। বেশিরভাগ এলাকাতেই ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গ্যাস থাকছে না। তবে মহেশখালীর ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গত বৃহস্পতিবার রাতে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এতে গৃহস্থালি, ব্যবসা–বাণিজ্য ও শিল্প–কারখানায় তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে চট্টগ্রামে। ফলে নাগরিকরা সময়মতো রান্না করতে পারছেন না। এতে একদিকে পরিবারের সদস্যদের খাদ্যগ্রহণ যে নিয়ম বা চক্র, তা ভেঙে পড়েছে এবং শরীরের ওপরও এর প্রভাব পড়ছে। অনেকে বেশি দামে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে খাচ্ছেন। এতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। গ্যাস সংকটের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষজন রান্না করতে না পারায় না–খেয়ে দিন–রাত কাটাচ্ছেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, প্রায় আড়াই মাসের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ শেষ করে মহেশখালীতে একটি এলএনজি টার্মিনাল চালু করার মুহূর্তে এতে কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ে। এতে চালু করা যায়নি গ্যাস সরবরাহ। অন্যদিকে, যে টার্মিনালটি থেকে এতদিন গ্যাস সরবরাহ হচ্ছিল, রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য সেটি থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। ফলে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে সারাদেশে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমানে মহেশখালীতে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল চালু আছে। এগুলোর প্রতিটির ক্ষমতা ৫০০ এমএমসিএফ/ডি। একটি পরিচালনা করে সামিট গ্রুপ। অপরটি পরিচালনা করে মার্কিন কোম্পানি এক্সেলারেট এনার্জি। এক্সেলারেট এনার্জি পরিচালিত টার্মিনালটিতে গত ১ নভেম্বর থেকে আড়াই মাস রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চলে। তখন থেকে সামিট পরিচালিত টার্মিনালটি থেকে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত ছিল। কিন্তু, গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় প্রায় তিন মাস ধরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন চট্টগ্রাম নগরবাসী।
চুলায় গ্যাস সরবরাহ না থাকায় নগরীর রেস্তোরাঁগুলোর সামনে মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। কিন্তু, রেস্তোরাঁগুলো চাহিদা অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করতে পারেনি। এতে অনেককেই খালি হাতে ঘরে ফিরতে হয়েছে।
আরপিজিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (এলএনজি) মো. শাহ আলমের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। সেখানে তিনি বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ থাকলেও জানুয়ারিতে এই সরবরাহ প্রায় ৪০ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটে। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু এখন গ্যাসের সরবরাহ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে। এলএনজি আমদানি করতে হয় স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে। ডলার সংকটের কারণে এই মুহূর্তে এলএনজি আমদানি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম। কিন্তু এখন এলএনজি টার্মিনালে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান তারা।
হঠাৎ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নগরের ফিলিং স্টেশনগুলোতেও গ্যাস মিলেনি। এ কারণে সড়কে কমে গেছে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চলাচল। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় এ নিয়ে ভোগান্তি ছিল তুলনামূলক কম।
গ্যাসের সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে শিল্প–কলকারখানার উৎপাদন। অনেক শিল্প–কারখানার কাজ দিনে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এছাড়া বাসাবাড়ি, সিএনজি স্টেশন, পেট্রোল পাম্প–সর্বত্রই একই অবস্থা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মূলত চাহিদানুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না থাকাই সংকটের মূল কারণ। মনে রাখা দরকার, দেশে ডলার আসার যে কয়টি ক্ষেত্র রয়েছে তার মধ্যে রপ্তানি বাণিজ্য অন্যতম। রপ্তানিমুখী শিল্প–কারখানা যদি গ্যাস সংকটে ভোগে, তাহলে উৎপাদন যেমন ব্যাহত হবে, তেমনি ডলার আয়ের প্রবাহ কমে গেলে এর প্রভাবও দেশের অর্থনীতিতে পড়বে। আবার গ্যাসের অভাবে বিকল্প জ্বালানির ব্যবহারে ব্যয় বেড়ে গেলে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়ে যাবে, যার প্রভাব অভ্যন্তরীণ তো বটেই, আন্তর্জাতিক বাজারেও পড়বে। চাহিদামাফিক উৎপাদিত পণ্য সময়মতো সরবরাহ করতে না পারলে কিংবা পণ্যের গুণগত মান ঠিক না থাকলে বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার কমিয়ে দিতে, এমনকি বাতিলও করতে পারেন, যা অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক হবে না। এ অবস্থায় গ্যাস সংকট কাটাতে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। আশা করছি, সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।