পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য পর্দা ফরজ। পর্দার বিধান ফরজ হওয়ার পর থেকেই এটি মুসলমানদের উপর অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে। আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধর্মীয় মাহফিলে উল্লেখযোগ্য অংশ থাকে নারীর পর্দার ওয়াজ। বলা হয়, নারীদের বেপর্দায় চলাফেরার কারণে সমাজে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। যদিও ইসলাম শুধু নারীদের জন্য পর্দার বিধান ফরজ করেনি, নারীর পাশাপাশি পুরুষদের জন্যও পর্দার বিধান রয়েছে। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ও খলিফাদের সময়ে নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও পর্দা মেনে চলেছেন। বর্তমান সমাজে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে নারীদের পর্দার বিধান নিয়ে তুলোধুনো করা হলেও পুরুষদের পর্দার বিষয়ে কোন আলোচনা করা হয় না। যেমন: সূরা আ’রাফের ২৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে আদম সন্তানরা, আমি তোমাদের উপর পোশাক (সংক্রান্ত বিধান) পাঠিয়েছি যেন তোমরা তোমাদের গোপন স্থানসমূহ ঢেকে রাখতে পার এবং সৌন্দর্যও ফুটিয়ে তুলতে পার, (তবে আসল) পোশাক হচ্ছে তাকওয়ার পোশাক, আর এটিই হচ্ছে উত্তম এবং এটা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের একটি অংশ, আশা করা যায় তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে’। এই আয়াতের মর্মার্থ অনুযায়ী শরীর ঢেকে রাখা প্রত্যেক নারী–পুরুষের জন্য ফরজ। মহানবী (সাঃ) কড়া নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, কোন ব্যক্তি তিনি নারী অথবা পুরুষ যেই হোন না কেন তিনি যেন কোনভাবেই পর্দা লঙ্ঘন না করেন। তিনি বলেন, যে আপন ভাইয়ের সতরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে অভিশপ্ত (আহকামুল কোরআন)। পুরুষদের জন্য শরীরের নাভি ও হাঁটুর মধ্যবর্তী অংশ ঢেকে রাখার জন্য মহানবী (সাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত আলী (রাঃ) জানান, নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা নিজের উরু কাউকে দেখাবে না এবং কোন জীবিত বা মৃত ব্যক্তির উরুর প্রতি দৃষ্টি দিও না (তাফসীরে কাবীর)। পুরুষদের জন্য ঘরে ঢুকার আগে অনুমতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই বিধান প্রবর্তন করার উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়ে থাকে যে, ঘরের ভেতরের স্ত্রী লোকদের কাউকে যেন এমন অবস্থায় দেখা না যায়, যে অবস্থায় তাদের দেখা আগুন্তুক পুরুষের উচিৎ নয়। সূরা আল নূরের ৫৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের সন্তানেরা যখন বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে যায় তখন তারা যেন সেভাবেই অনুমতি নেয়– যেভাবে তাদের আগে (বড়োরা) অনুমতি নিত’। আল্লাহতায়ালা অন্য এক আয়াতে বলেছেন– হে ঈমানদারগণ, তোমরা কখনো নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কারো ঘরে অনুমতি না চেয়ে ও তার বাসিন্দাদের প্রতি সালাম না করে প্রবেশ কর না– সূরা নূর– ২৭। এই দুটি আয়াতের মাধ্যমে নারীকে পুরুষের দৃষ্টি থেকে নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই নির্দেশ লঙ্ঘনকারীদের জন্য রাসূল (সাঃ) কঠোর শাস্তির ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘যদি কেহ অনুমতি ছাড়া অন্যের ঘরের ভেতরে তাকিয়ে দেখে, তাহলে তার চক্ষু উৎপাঠিত করার অধিকার ঘরের অধিবাসীদের রয়েছে (মুসলিম শরীফ)। তাছাড়া অপরিচিত লোকদের সু–স্পষ্টভাবে আদেশ করা হয়েছে যে, যদি অন্যের ঘর থেকে কিছু চাওয়ার প্রয়োজন হয় তবে গৃহে প্রবেশ না করে বাহিরে পর্দার অন্তরাল থেকে চাইতে হবে। এভাবে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিড়ম্বনা থেকে নারীরা রক্ষা পাবে। পুরুষদের জন্য পর্দার বিধান হচ্ছে– তারা নিভৃতে কোন নারীর সঙ্গে আলাপ করবে না এবং শরীর স্পর্শ করতে পারবে না, সে যতই নিকটতম বন্ধু বা আত্নীয় হোন না কেন। হযরত উকবা বিন আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত– রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘সাবধান! নিভৃতে নারীদের নিকট যেও না’ (বুখারী, মুসলিম, তিরমিজি)। অন্য এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘স্বামীর অনুপস্থিতিতে কোন নারীর নিকট যেও না, কারন শয়তান তোমাদের যে কোন একজনের মধ্যে রক্তের ন্যায় প্রবাহিত হবে (তিরমিজি)। এছাড়া পরনারীকে স্পর্শ করলে পরকালে তার জন্য কঠিন শাস্তির বিধানের কথা উল্লেখ করে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যদি কেহ এমন কোন নারীর হস্ত স্পর্শ করে, যার সঙ্গে তার কোন বৈধ সম্পর্ক নেই, তাহলে পরকালে তার হাতের উপর জলন্ত আগুন রাখা হবে’। এই ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে সূরা আন নূর এর ৩০ নং আয়াতে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘(হে নবী) তুমি মুমিন পুরুষদের বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিম্নগামী করে রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানসমূহ হেফাজত করে; এটা তাদের জন্য উত্তম পন্থা; তারা যা করে, আল্লাহতায়ালা সেই সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গভাবে অবহিত রয়েছেন’। এই আয়াতের মাধ্যমে পুরুষদের দৃষ্টি সংযত রাখার আদেশ করেছেন। এটি নারীদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। পথেঘাটে চলতে ফিরতে কোন নারীর উপর হঠাৎ করে কোন পুরুষের দৃষ্টি পড়ে গেলে ইসলামের বিধান হচ্ছে– সে তাৎক্ষণিক দৃষ্টি সংযত করবেন এবং দ্বিতীয়বার দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন না। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন অপরিচিত নারীর প্রতি যৌন লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, কেয়ামতের দিন তার চোখের উপর উত্তপ্ত গলিত লৌহ ঢেলে দেওয়া হবে (ফাতহুল কাদির)। আল্লাহতায়ালা তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন: যেগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করা আমি হারাম করেছি, ঐগুলোর প্রতি দৃৃষ্টিপাত কর না। হারাম জিনিস হতে চক্ষু নিচু করে নাও। যদি আকস্মিকভাবে দৃষ্টি পড়েই যায় তাহলে দ্বিতীয়বার দৃষ্টিপাত কর না। হযরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ আল বাজালি (রাঃ) থেকে বর্ণিত– তিনি বলেন, আমি রাসূল (সাঃ) কে হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন– সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নিবে। (মুসলিম শরীফ ৩/১৬৯৯)। হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন– পথের উপর বসা থেকে তোমরা বেঁচে থাক। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)- যদি অন্য কোন ব্যবস্থা না থাকে এবং কথা বলাও জরুরী হয়? উত্তরে তিনি বললেন– এমতাবস্থায় পথের হক আদায় করবে। সাহাবীগণ আবার জিজ্ঞাস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) পথের হক কি? জবাবে তিনি বললেন– দৃষ্টি নিম্নমুখী করা, সালামের উত্তর দেওয়া, ভালো কাজের আদেশ করা এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা (ফাতহুল বারী ৫/১৩৪)। আবুল কাশিম আল বাগাবি (রাহঃ) আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, ‘তিনি রাসূল (সাঃ) কে বলতে শুনেছেন– তোমরা আমাকে ৬টি জিনিসের নিশ্চয়তা দাও, তাহলে আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের দায়িত্ব নিব। ৬টি জিনিস হল: কথা বলার সময় মিথ্যা বল না, আমানতের খেয়ানত কর না, ওয়াদা ভঙ্গ কর না, দৃষ্টি নিম্নমুখী রাখবে, হাতকে জুলুম করা থেকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে (তাবারানি ৮/৩১৪, ইবনে হিব্বান ২/২০৪)। দৃষ্টি পড়ার পর অন্তরে ফাসাদ সৃষ্টি হয় বলেই লজ্জাস্থানকে রক্ষা করার জন্য দৃৃষ্টি নিম্নমুখী করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দৃষ্টিও ইবলিশের তীরসমূহের মধ্যে একটি তীর। সুতরাং ব্যভিচার থেকে বেঁচে থাকার জন্য দৃষ্টিকে নিম্নমুখী রাখাও জরুরি।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল