দৈনিক আজাদীতে গত ১৫ জানুয়ারি ‘বাড়ছে শীতজনিত রোগ: হাসপাতালে চাপ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাড়ছে শীতজনিত রোগ। শীতের তীব্রতা বাড়ায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু ও বৃদ্ধরা। এই সময়ে শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ছে। এছাড়া বৃদ্ধদের কফ–কাশির সাথে শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের নিয়মিত টিকাদান, স্বাস্থ্যকর জীবন এবং পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা, এই তিনটি বিষয় নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে পারে। এছাড়া ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা পেতে শিশুর মাথায় হালকা টুপি এবং হাতে–পায়ে মোজা পরাতে হবে। ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে হবে। কোনোভাবেই আগুনের ধোঁয়া জাতীয় কিছু দিয়ে শিশুর শরীরে উষ্ণতা বাড়ানোর চেষ্টা করা যাবে না। ঘরের বাইরে গেলে বড়দের যে পরিমাণ শীতের কাপড় প্রয়োজন হয়, শিশুকেও যেন একইধরনের কাপড় পরানো হয়। খুব বেশি যাতে পরানো না হয়। আর শিশুকে সবসময় পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগে বর্তমানে ধারণ ক্ষমতার তিনগুণ রোগী ভর্তি রয়েছে। এর এক তৃতীয়াংশ আবার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগী। একইসাথে নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগী বাড়ছে চট্টগ্রাম মা শিশু ও জেনারেল হাসপাতালেও। অন্যদিকে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে বাড়ছে শীতজনিত রোগে আক্রান্তরা।
চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মির্জা নুরুল করিম দৈনিক আজাদীকে বলেন, শীতের সময় কিছু কিছু রোগের প্রকোপ বাড়ে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়া। তাই বয়স্ক লোকদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে নিয়মিত মাস্ক পরতে হবে। এছাড়া নিজেকে উষ্ণ রাখতে হবে।
বলা জরুরি যে, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যে মানুষের অধিকার, কারো দয়া বা করুণার বিষয় নয়– এটাও সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে বোঝানো এবং সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে যারা সেবা প্রদানকারীর ভূমিকায় আছেন তাদের জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরির জন্য সচেষ্ট হতে হবে। অধিকারভিত্তিক একটি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারলেই এইসব ক্ষেত্রে অর্জন, এসডিজির গোলসমূহ অর্জন করা এবং সর্বোপরি যে কোনো বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতি আরও সুদৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করা সহজতর হবে। স্বাস্থ্য অধিকারের দাবিতে দেশে একটি স্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সারা বিশ্বের সিদ্ধান্ত। শুধু বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত নয়। প্রত্যেক মানুষ, সর্বস্থানে এবং সর্বস্তরে স্বাস্থ্য সেক্টরের একটি অ্যাকসেস থাকতে হবে। এটি আমাদের জন্মগত অধিকার, এটি রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতেই হবে। শুধু আমার পকেটে টাকা নেই বলে আমি স্বাস্থ্যসেবা পাব না, তা কিন্তু হবে না। কাজেই সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এটি দেশের উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকার দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে যখন প্রয়োজন তখনই যেকোনো ধরনের চিকিৎসাসেবা বিনা মূল্যে গ্রহণ করতে পারবে, তখনই আমাদের দেশে ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হবে। এ জন্য আরো লম্বা পথ পাড়ি দিতে হতে পারে; যদিও আমাদের মতো এত জনবহুল দেশের সব মানুষকে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া কঠিন। তবু সরকারের উদ্যোগ থাকলে তা অসম্ভব হবে না। আমাদের দেশে এখনো সরকারি যে স্বাস্থ্যসেবা বিদ্যমান, তা অনেক দেশের চেয়ে ভালো। আমাদের যে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি আছে, তা অনেক দেশেই নেই। হাসপাতালগুলোতে ফ্রি সেবা দেওয়া হয়, ওষুধ দেওয়া হয়। তাতেই কি আমরা সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারবো। যেভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুশাসন দিয়েছিলেন স্বাস্থ্য সেক্টরকে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিভিশন করার জন্য, সেটি কিন্তু পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, সেবার মধ্যে আমরা দেখেছিলাম সব জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং সব প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার–এগুলো ছিল সেবার অধীনে। এখন দেখা যাচ্ছে যে ২০ শতাংশ শিক্ষা এবং আর ৮০ শতাংশই সেবার অধীনে। এখন স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ফ্যামিলি প্ল্যানিংসহ যে ছয়জন ডিজি আছেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোনো সমন্বয় মিটিং আমরা আজ পর্যন্ত দেখি না। মনিটরিং ঠিকমতো হচ্ছে না; যার কারণে দুর্নীতি ও অনিয়ম স্বাস্থ্য খাতকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। এটি হচ্ছে উপযুক্ত পর্যায়ের মনিটরিং ও পরিকল্পনার অভাবে।
অন্যদিকে কেউ কেউ বলছেন, স্বাস্থ্য খাতে যে বাজেট হচ্ছে, সেটাকে সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করতে হবে অর্থাৎ দুর্নীতিমুক্ত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি কস্ট ম্যানেজমেন্ট ও পরিকল্পিত উপায়ে করা সম্ভব হলে সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যেতো। আরেকটা বিষয় হলো মনিটরিং। মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত দুর্বল। আমরা শুধু জানি আমাদের এই উদ্যোগ নেওয়া দরকার তাই নেওয়া হয়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়নে সরকারি যে কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু, তা আমরা এখনো নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা চাই, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি সবার আস্থা আসুক, বজায় থাকুক মমত্ববোধ, ধীরে ধীরে আরো উন্নত হোক আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা, সাধারণ মানুষ পাক তাদের প্রত্যাশিত চিকিৎসাসেবা। তবেই নিশ্চিত হবে সবার জন্য স্বাস্থ্য।