নির্বাচন শেষ। নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগের সামনে যে চ্যালেঞ্জ এবং যে করণীয় তার একটি পর্যালোচনার সময় এসেছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যে সব বিষয় সর্বাগ্রে বিবেচ্য বলে প্রতীয়মান তার একটি ক্রম অগ্রাধিকার এ লেখায় আলোচনার প্রয়াস পেয়েছি। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক মহল হয়ত ইতিমধ্যে এসব বিষয় নিয়ে তাদের কৌশল বা পদক্ষেপ ঠিক করে রেখেছেন। প্রথমত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে আওয়ামী লীগ তার স্বীয় নেতাদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করেছে। এটি করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নিজ দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা কর্মীদের মাঝে নানা ধরনের ভুলবুঝাবুঝি, সংঘাত সংঘর্ষের সৃষ্টি করেছে। এখন দূরত্ব সৃষ্টির এ বিষয়টি নিরসন করে দলের ঐক্য এবং একতা ফিরানো আওয়ামী লীগের আশু চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। একথা সর্বজন বিদিত আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার তৃণমূল পর্যায়ের নেতা কর্মীরা। এই সব নেতা কর্মীদের সংঘাত সংঘর্ষ দ্বিধাবিভক্তি বিদ্যমান থেকে গেলে তা দলের শক্তিক্ষয় ঘটাবে।
দ্বিতীয়ত দলের নেতাদের উপর জনগণের আস্থা ফিরানো। নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে গিয়ে দলের নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে অনেক সত্যমিথ্যা অভিযোগ সামনে এনেছে। এসব অভিযোগ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বা দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানও তুলে ধরেছে। অভিযোগগুলি ধর্তব্যের মধ্যে নিয়ে জনগণকে সত্য অবগত করানো। এটি অসংকোচে করতে পারলে সাধারণ মানুষের আওয়ামী লীগের উপর আস্থাকে দৃঢ় ভিত্তি দান করবে।
তৃতীয়ত অর্থনীতিকে বেগবান করতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ সমূহ আওয়ামী লীগকে কার্যকর এবং দূরদর্শিতার সাথে সামাল দিতে হবে। অর্থনীতিতে আওয়ামী লীগের অর্জন অসামান্য। এটি কৃষি উৎপাদনে, কৃষিতে উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিতকরণে, তৈরী পোশাক খাতে মৎস্য উৎপাদনে, করোনাকালীন শিল্পকারখানার সাহসী উদ্যোগ আয়োজনে মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্ত্তু ব্যাংক খাতের দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং লাগামহীনতা আওয়ামী লীগের সেইসব অর্জনকে ম্লান করেছে। ব্যাংক খাতের অপছায়ার করালগ্রাস শিল্প কারখানায় ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলে। এ দুষ্টুচক্র আওয়ামী লীগের আর্থিক ব্যবস্থাপনার সক্ষমতাকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তেমনিভাবে তা আওয়ামী লীগকে ব্যাপকভাবে সমালোচনার মুখোমুখিও দাঁড় করিয়েছে।
ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ এবং ফলশ্রুতিতে পশ্চিমাদের স্যাংশনের গ্যাড়াকলে পড়ে আমাদের মত অর্থনীতির দেশগুলি চরম প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখিন হয়। আওয়ামী লীগ সরকার এ অবস্থা থেকে উত্তরণ পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে এমন অবস্থায় হামাস তথা ফিলিস্তিন–ইসরাইলী যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে। এসব প্রতিকূলতা দেশের আর্থিক খাতে তীব্্র ডলার সংকটের সৃষ্টি করে। এর ফলশ্রুতিতে রিজার্ভের উপর চাপ সৃষ্টি হয়। এখন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রীকে আশু এ বিষয় সমূহের উন্নতি কল্পে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে একই সাথে মুদ্্রাস্ফীতি এবং দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগামও টেনে ধরতে হবে।
চতুর্থত কূটনীতি। ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরীতা নয়’ পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর এ নির্দেশনা আওয়ামী লীগের ঘোষিত বৈদেশিক নীতি। বিগত দিনে এ নীতির উপর দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্ব অঙ্গনে তার কূটনৈতিক চাল বেশ সফলভাবে চেলেছে বলে প্রতীয়মান। যদিও আমরা লক্ষ্য করেছি সময়ে সময়ে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে আওয়ামী লীগ সরকার এক ধরনের টানাপোড়েনের জাল টানাটানি করেছে। তবে তারা তা চরম কোন পর্যায়ে পৌঁছেতে দেয়নি বরং কৌশলে সামাল দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ দুই বিপরীত অবস্থানের শক্তি ভারত – চীনকে নিজের সমর্থনে এক করতে দারুণ সফলতা দেখিয়েছে। এ দুই দেশের সাথে ভারসাম্যমূলক নীতি প্রণয়ন আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কূটনীতির জন্য অবশ্যই চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কূটনীতি রাশিয়াকেও প্রবল ভাবে কাছে টানতে সমর্থ হয়েছে। মধ্যপ্রাচের দেশগুলির সাথে সর্ম্পক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, তুরস্কের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটানোও বৈদেশিক নীতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্যের সাক্ষ্য দেয়।
তবে এ সমস্ত অর্জনকে চাপিয়ে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে প্রত্যাবসনে ব্যর্থতা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য ভবিষ্যৎ এও চ্যালেঞ্জ হিসাবে থেকে যাবে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং কূটনীতির জন্য বড় হুমকি। এ বিষয় বিবেচনায় রেখে আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে পথ চলতে হবে এবং দ্রুততর সময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পঞ্চমত সামাজিক উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপ সমূহকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। গৃহহীন ছিন্নমূল মানুষদের জন্য আবাসন তৈরী, বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা, সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু, হতদরিদ্রদের মাঝে সুলভমূল্যে বা বিনা মূল্যে খাদ্য সহায়তা আওয়ামী লীগের যুগান্তকারী পদক্ষেপ সমূহের মধ্যে সবচেয়ে কল্যাণমুখী। এ উদ্যোগ সমূহের বিস্তার ঘটানো এবং এক্ষেত্রে আরো নতুন নতুন সৃষ্টিশীল সামাজিক উদ্যোগ আওয়ামী লীগকে সাফল্যের সোপানে নিয়ে যাবে।
ষষ্ঠত শিক্ষাক্ষেত্রে সৃজনশীলতা এবং উৎপাদনমুখিনতাকে প্রাধান্য দেওয়া। সারাদেশে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে বিনামূল্যে বই বিতরণ আওয়ামী লীগের এক বিশাল অর্জন। এ অর্জনের বিপরীতে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এ যাবৎ আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেকটা নির্লিপ্ত। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গরিষ্ঠ সংখ্যক শিক্ষক ৭৩ সালের বিশ্ব–বিদ্যালয় এ্যাক্ট এর বদৌলতে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম, গবেষণা কর্ম ইত্যাদিতে ব্যস্ত না রেখে রাজনীতির অঙ্গনে বেশি মাতামাতিতে ব্যস্ত। ফলশ্রুতিতে আমাদের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অনেকক্ষেত্রে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সত্যিকার অর্থে সৃষ্টিশীল একটি জাতি হিসাবে গড়ে তুলতে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কারে নতুন সরকারকে আত্মনিয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে ৭৩ সালের এ্যাক্টকে পরিবর্তন পরির্মাজন করা যেতে পারে। বর্তমান সরকারের সে শক্তি এবং সার্মথ্য আছে।
সপ্তমত দুর্নীতির দৈত্যকে বোতলে ভরে চিরতরে কবরস্থ করা। দুর্নীতির দৈত্য বিগত দিনে আওয়ামী লীগের অনেক অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিলে তার হারাবার কিছু নাই জনগণের আরো বেশি আস্থাভাজন হওয়া ছাড়া। এক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে তা আওয়ামী লীগের শিরস্ত্রাণে আরো একটি অর্জনের পালক যোগ করবে নিঃসন্দেহে।
অষ্টমত রাজনীতিতে বিরোধী দল সমূহকে আস্থায় আনা। অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ নির্বাচন গণতন্ত্রের মূল শক্তি। এর ব্যতিক্রম গণতন্ত্রের অঙ্গহানির নামান্তর। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মূল বিরোধী দল বি এন পি অংশ গ্রহণ করেনি। বি এন পি’র জন্য এ বর্জন যেমন কোনো রাজনৈতিক অর্জন বয়ে আনবে না তেমনি ক্ষমতাসীনদের জন্যও এর মাঝে আত্মতুষ্টির কোনো কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয় না। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেওয়ার মাঝে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা নিজের আসন নিশ্চিত হওয়ায় নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারেন। কিন্ত্তু আওয়ামী লীগের মৌল ভিত্তি তার ক্রমাগত সংগ্রামে। এ সংগ্রাম রাষ্ট্রভাষা, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা, গণ অভ্যূত্থান, স্বাধীনতা সংগ্রাম –স্বাধীনতা অর্জন থেকে বর্তমানের দেশের অর্থনৈতিক বিনির্মাণ–সবখানে। অতএব বিরোধী দল সমূহকে আস্থায় আনতে না পারার মাঝে আওয়ামী লীগের জন্য আত্মতুষ্টির বা অর্জনের কিছু নেই বরং আস্থায় নিয়ে আসতে পারার মাঝেই তার গৌরব নিহিত। আওয়ামী লীগকে এ প্রচেষ্টায় তার আন্তরিক শক্তি আর সামর্থ্য নিয়োজিত করতে হবে।
৭ জানুয়ারী ২৩ আমাদের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দিন ডেভিড বার্গম্যান নামক এক বৃটিশ সাংবাদিক লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস এর ওরিয়েন্টাল এবং আফ্রিকান স্টাডিজের প্রফেসর অবিনাশ পালিওয়াল’এর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন। সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয় নভেম্বর ২০২৩ এ। সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে প্রফেসর পালিওয়াল উল্লেখ করেন Both sides wanted the other to escalate and then to trip. They want the other to over –escalate. The AL wants the BNP to burn more buses. And the BNP wants AL to kill more people.
এ বক্তব্যের সারমর্ম বা মোদ্দা কথা হল আওয়ামী লীগ– বি এন পি দুটি দল পরস্পরকে ঘায়েল করার জন্য আওয়ামী লীগ চায় বিএনপি বেশি বেশি বাসে আগুন দিক আর বিএনপি চায় আওয়ামী লীগ বেশি করে মানুষ হত্যায় লিপ্ত হোক। আমি মনে প্রাণে কামনা করি অবিনাশ পালিওয়াল’এর বক্তব্য সর্বৈব মিথ্যা বলে প্রমাণ হোক।
আওয়ামী লীগ একটি অন্তর্ভূক্তিমূলক রাজনীতির শুভ সূচনা করুক। বি এন পি’ রাজনীতির মাঠে আরো প্রজ্ঞাবান হোক। এদেশের রাজনীতির পুরোধা পুরুষদের সেই অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির শ্লোগান বা প্রতীতি হোক প্রিয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিখ্যাত কবিতার ঈষৎ এই পরিবর্তনের মাধ্যমে :
প্রাণপণে এদেশের সরাব জঞ্জাল,
এ দেশকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক