সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল নতুন শিক্ষাক্রম ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নতুন কারিকুলাম বিষয়ে বিচার–বিশ্লেষণ করে দেখছি। এখানে যেসব বিষয়গুলো পরিবর্তন করা প্রয়োজন, সেগুলো অবশ্যই পরিবর্তন করা হবে। শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বনানীতে নিজ বাসায় এডুকেশন রিপোটার্স এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ইরাব) নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাতে শিক্ষামন্ত্রী এসব কথা বলেন।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মূল্যায়ন পদ্ধতির চ্যালেঞ্জের কথা যদি বলেন সেখানে বলবো, নতুন শিক্ষাক্রমে কিছু বিষয় যোগ হয়েছে। এগুলো আমরা দেখছি। এখানে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে আরও বেশকিছু পরিবর্তন করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে এখন যে একেবারে শতভাগ স্থায়ী তা কিন্তু নয়। আমরা এর আগেও বলেছি, আমাদের সে সংশোধনগুলো আসবে সেগুলো আমরা সমাধান করবো।
তিনি আরও বলেন, কর্মসংস্থান সংশ্লিষ্ট যত দক্ষতা আছে, সেগুলো আমরা আমাদের কারিকুলামে নিয়ে আসতে চাই। এতে করে আমাদের শিক্ষার্থীরা কর্মসংস্থানের বিষয়টি মাথায় রেখে নিজেদের শিক্ষা বিষয়ে পরিকল্পনা সাজাতে পারবে। মূলত কর্মসংস্থানের বিষয়টি মাথায় আমরা নিজেরাও পুরো শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে চাই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো পরীক্ষা ভীতি থাকবে না। বাড়ির কাজের চাপ কমিয়ে শিক্ষার্থীদের বাস্তবমুখী এবং যুগোপযোগী শিক্ষাদান ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত কোনো প্রাইভেট, কোচিং পড়তে হবে না। প্রাইভেট বা কোচিং প্রথাকে সম্পূর্ণভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বর্তমান শিক্ষাক্রমে। শিক্ষার্থীরা আনন্দঘন পরিবেশে লেখাপড়া করে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে, এটাই সকলের প্রত্যাশা।
মানুষ মাত্রই শৈশব থেকে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে থাকে। এই অভিজ্ঞতাগুলোকে শাণিত করার জন্য দরকার উপযুক্ত শিক্ষা। শিক্ষার অন্যতম উপকরণ বই। আগের পাঠ্যবইয়ে শুধু পাঠ আলোচনা থাকত। এবারের নতুন বইয়ে পাঠ আলোচনার পাশাপাশি কিছু নির্দেশনা যোগ করা হয়েছে। নির্দেশনাগুলো পালন করে পাঠে অগ্রসর হতে হবে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে যাবে এবং আরেকটি অভিজ্ঞতা নিয়ে বের হবে। শিক্ষকের সহায়তায় নতুন পাঠ্যবই শিক্ষার্থীকে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের দিকে নিয়ে যাবে। বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত যোগ্যতাগুলোয় পারদর্শিতা অর্জন করবে। পারদর্শিতা অর্জনের দিকে লক্ষ রেখে নতুন পাঠ্যবইয়ের বর্ণনায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আমরা যদি পরিবর্তন বুঝতে পারি, তাহলে নতুন বই অনুশীলন করতে মোটেও অসুবিধা হবে না।
বাংলাদেশে এতদিন যে শিক্ষাক্রম চালু ছিল, মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সেটিতে পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে সেই জায়গা থেকে সরে আসা হয়েছে। এখন পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর শিখনকালীন মূল্যায়ন বা ধারাবাহিক মূল্যায়নকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আগে যেখানে প্রথম শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হতো, সেখানে এখন প্রাথমিক স্তরে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনও পরীক্ষা থাকছে না। এছাড়া চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষার পাশাপাশি ধারাবাহিক মূল্যায়নের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে আবশ্যিক বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়গুলোর পরীক্ষা বাদ দেওয়া হয়েছে।
তবু নতুন পাঠ্যক্রমের সমালোচনা করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধন করেছেন অভিভাবকেরা। বিতর্ক চলছে চারদিকে।
তাঁরা বলেন, কারিকুলাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সাধারণত আগের কারিকুলাম থেকে ১০ থেকে ২০% পরিবর্তন করার কথা বলা হয় এবং তা করার ক্ষেত্রে পূর্বশর্তগুলো হাজির রাখতে হয়। কিন্তু এই কারিকুলামের কোনও পূর্বশর্ত হাজির না করে আগেরটার খোলনলচে–সহ সব পালটে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষকদের প্রচুর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তত করে তুলতে হবে। শিক্ষকরা হয়তো কিছুটা ট্রেনিং পেয়েছেন। কিন্তু শিক্ষাক্রমে যেভাবে পরিবর্তন আনা হয়েছে, হুট করে সেটার সাথে তাল মেলানো সবার পক্ষে কঠিন, ছাত্র–ছাত্রীদের পক্ষেও কঠিন। নতুন শিক্ষাক্রম গ্রহণ করা হলেও সেটি বাস্তবায়নের জন্য মাঠ প্রস্তুত নেই বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদদেরও কেউ কেউ। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশে এমনিতেই শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল। তারপরও শিক্ষক যারা আছেন, তারা কি এই পাঠ্যক্রমে পড়ানোর জন্য প্রস্তুত? সেই প্রশিক্ষণ বা সক্ষমতা কি তাদের আছে? তাঁরা আরও বলেন, ‘এটি বাস্তবায়নের জায়গায় অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। মাঠ প্রস্তুত না করে কেবল নতুন শিক্ষাক্রম করলে সেটি কোনও কাজে তো আসবেই না, বরং হিতে বিপরীতও হতে পারে।
তবু শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, নতুন কারিকুলাম বিষয়ে বিচার–বিশ্লেষণ করে পরিবর্তন প্রয়োজন হলে করবেন। আমরা চাই নতুন শিক্ষাক্রম ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সর্বজনগ্রাহ্য হোক।