বর্তমানের শিখনে বৈশ্বিক নাগরিক হয়ে গড়ে উঠুক শিক্ষার্থীরা

অধ্যক্ষ ছন্দা চক্রবর্তী | বুধবার , ১০ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:২৮ পূর্বাহ্ণ

দেশের প্রাক প্রাথমিক, প্রাথমিক, ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া বিনামূল্যে বই প্রদান উৎসবের মতো নতুন বছর ২০২৪ সালও শুরু হলো যথারীতি বই উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে। চালু হলো নতুন শিক্ষাক্রম। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে প্রথম বারের মতো দ্বিতীয়, তৃতীয় অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এবং দ্বিতীয় বারের মতো প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এই বছর থেকে চালু হয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে সবশেষে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এ শিক্ষাক্রম চালু হবে। সরকার বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহ এর শিক্ষাক্রম গবেষণা করে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলতে চায়। কারণ ২০৩০ সালের মধ্যে এস,ডি জি উন্নয়নের চার নম্বর লক্ষ্য তথা আন্তর্জাতিক শিক্ষা মানের অভিষ্ট পূরণ করতে বদ্ধ পরিকর। সরকার প্রধান, বই উৎসবে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, ‘শিক্ষার ক্ষেত্রে যত টাকা লাগে আমি দেব। বিশ্বে যত নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তারা কীভাবে শিক্ষা দেয়, কী কারিকুলাম শেখায়, সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা সেরকম আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে চাই’। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাবনার কথা স্মরণ করে বললেন, “জাতির পিতা বলতেন– ‘শিক্ষায় যে খরচ, সেটা হচ্ছে বিনিয়োগ’,’’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সময়ের রাজনৈতিক নানা টানাপোড়েনের মধ্যেও ১ জানুয়ারি দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাক্রমের বই বিতরণ করা হয়েছে। তবে সব প্রতিষ্ঠানে সব বিষয়ের বই বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বই ছাপানোর কাজ শেষ করতে না পারায় সব বিষয়ের বই সবার হাতে দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি, আবার বিতরণ করা সব বইয়ের ছাপার মানও নিম্ন মানের যেমন হয়েছে, তেমনি কোনো কোনো বইএ ভুলভ্রান্তিও দেখা যাচ্ছে। তবে খুব তাড়াতাড়ি সবার হাতে সব বই পৌঁছাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ।

আগের সৃজনশীল শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছিল ২০১২ সাল থেকে। এর ১০ বছর পর এই নতুন শিক্ষাক্রম তথা জীবনমুখী শিক্ষার চলমান প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। এই শিক্ষাক্রমে শিখন ও শেখানোর ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। বাঙালি জাতি সবসময় আবেগী এবং স্মৃতিকাতরতায় ভোগা জাতি। পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর মতো মানসিক দৃঢ়তার প্রয়োজনকে গ্রহণ করতে ভয় পায়, তাই আলোচনার কেন্দ্রে নতুন শিক্ষাক্রম। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সকলের বুঝতে হবে যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে তাল মিলানো বা খাপ খাইয়ে নিতে হলে যুগের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাক্রম পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

সরকার বিশ্বের মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নকারী দেশ সমুহের উপর গবেষণা করেই এই নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই শিক্ষাক্রম চালু তে নেতিবাচক আলোচনা নিরসনের জন্য প্রথমে ২০২২ সালে শুধু ৬২টি প্রতিষ্ঠানের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পরীক্ষামূলকভাবে আরম্ভ করেছিল। এর পরে ২০২৩ সাল থেকে ২০২৭ সালকে লক্ষ্য রেখেই এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই শিক্ষাক্রম প্রণয়নের ফলে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার সুযোগ পাবে, তাই এই পদ্ধতিকে জীবনমুখী শিক্ষাপদ্ধতি বলে অভিহিত করা হচ্ছে। তারপরেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান, প্রতিটি বিষয়ের বইএর শুরুতে ‘প্রসঙ্গ কথায়’ লিখেছেন ‘পাঠ্যপুস্তকগুলি নতুন শিক্ষাক্রমের পরীক্ষামূলক সংস্করণ। মাঠ পর্যায়ে ব্যবহারের পর প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশের ভিত্তিতে এর প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন সাধন করা হবে’।

এ বছরের নতুন শিক্ষাক্রমের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বড় পরিবর্তন হল, সুদীর্ঘকাল হতে চলমান নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন পদ্ধতির অবসান। ১ জানুয়ারি ২০২৪ থেকে নবম শ্রেণিতে আগের মতো বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক নামে আলাদা বিভাগ থাকছে না। নবমদশম শ্রেণিতে প্রত্যেকের জন্য অভিন্ন ১০টি বিষয় পড়তে হবে। তা ছাড়া এতদিন যেমন নবমদশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এস,এস,সি পরীক্ষা হতো, সেই এস,এস,সি পরীক্ষা হবে শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির উপর। আবার একাদশ শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন (বিজ্ঞান ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক) নির্ধারণ প্রক্রিয়া চালু হবে। এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির উভয় পাঠ্যসূচি নিয়ে যেমন এইচ.এস.সি হতো, এখন নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বোর্ডের অধীনে বর্ষ শেষে আলাদা ভাবে বোর্ড পরীক্ষা হবে। এক্ষেত্রে দুই শ্রেণির বর্ষ শেষের ফলাফল সমন্বয় করে এইচ,এস,সির ফলাফল তৈরি হবে। কারিগরী বোর্ডের অধীনে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পদ্ধতি শুরু থেকেই এই প্রক্রিয়ায় চলমান ছিল এবং রয়েছে। আরোও চমকপ্রদ পরিবর্তন হলো পরীক্ষার ফলও আগের মতো সব ক্ষেত্রে জিপিএ এর ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে না। নতুন পদ্ধতির মূল্যায়নে তিনটি চিহ্ন দিয়ে শিক্ষার্থিদের অর্জিত অবস্থান নির্ণয় করা হবে। যেমনত্রিভূজ চিহ্নের মাধ্যমে বোঝানো হবে শিক্ষার্থী-‘দক্ষ’। বৃত্ত দিয়ে বোঝানো হবে-‘অগ্রগামী বা মাঝারি’। এবং চতুর্ভুজ এর মাধ্যমে বোঝানো হবে পারদর্শিতার -‘প্রারম্ভিক স্তর’।

প্রথম দিকে যেভাবে নতুন শিক্ষাক্রমের উপর নেতিবাচক আলোচনার ঝড় উঠেছিল তা মনে হয় ইদানীং কমেছে। তার কারণ শিক্ষামন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা অধিদপ্তর এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণের যুক্তিমূলক বক্তব্য, আলোচনার প্রেক্ষিতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকেই নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন বলে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, ‘আমরা চাই আমাদের দেশটা যেন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। সে জন্য আমাদের কারিকুলামগুলোতে পরিবর্তন আনা হয়েছে’।

শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ও মুখ্য বিষয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। অনেক শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়ে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে আশাবাদী। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মতে নতুন শিক্ষাক্রমটি যোগ্যতাভিত্তিক, যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে এমন সব যোগ্যতা শেখানো হবে, যা সে জীবনযাপনের বাস্তব কাজে প্রয়োগ করতে পারে। তাইতো এ পদ্ধতিতে জিপিএর বদলে যোগ্যতা অর্জনে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতাকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে ফলাফল নির্ধারণ হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষাক্রমের অন্যতম উপকরণ বই। এই বই ও বিষয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাসেরও পরিবর্তন করতে হবে। আগের পাঠ্যবইয়ে শুধু পাঠ আলোচনা থাকতো, এখনের নতুন বইয়ে পাঠ আলোচনার সাথে কিছু নির্দেশনাও যোগ করা হয়েছে, যাতে শিক্ষকের সহায়তায় নির্দেশনাগুলো পালন করে পাঠে অগ্রসর হওয়া যায়। এই নির্দেশনাগুলো পালন করতে করতে তাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা হবে এবং এভাবে শিক্ষার্থী নির্ধারিত নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যোগ্যতার পারদর্শিতা অর্জন করবে।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করার উদ্দ্যেশ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ, শিক্ষাবিদগণ, গবেষকদের আলোচনা মতে যোগ্যতা শব্দটির যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তা হলো নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী যোগ্যতার চারটি উপাদান যথা: জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ। নতুন শিক্ষাক্রমে এই চারটি উপাদান নিয়ে শিক্ষার্থী যোগ্যতা অর্জন করবে এবংবিশ্বনাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে।

শিখন ও শেখানো প্রক্রিয়ায় যেসব পরিবর্তন নতুন শিক্ষাক্রমে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে তা হলো, আগের শিক্ষা ছিল-‘মুখস্থ নির্ভর’, বর্তমানশিক্ষা হলো ‘হাতেকলমে শেখা’। আগের শিখন প্রক্রিয়া ছিল ‘শিক্ষক কেন্দ্রিক, ’বর্তমান প্রক্রিয়া হলো ‘শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক’। আগে একঘেঁয়েমি পীড়নের মাধ্যমে শেখা, এখন হাতেকলমে আনন্দের মাধ্যমে শেখা। আগে একা একা পড়া ও শেখা, এখন দলবদ্ধভাবে বোঝা ও শেখা। আগের শিখন প্রক্রিয়া যোগ্যতা ভিত্তিক ছিল না, নতুন শিক্ষাক্রম যোগ্যতা ভিত্তিক। আগে সফট স্কিলস ছিল সীমিত, কিন্তু বর্তমানের শিক্ষাক্রমে অবারিত সফট স্কিলস অর্জন এর সুযোগ রয়েছে। আগে পরীক্ষাভীতি প্রাধান্য পেতো এখন পরীক্ষাভীতি নেই। মূল্যায়ন ছিল পরীক্ষা নির্ভর, বর্তমানে ধারাবাহিক মূল্যায়নে বিশেষ গুরুত্ব। কোচিং, গাইড বই এর খরচ এর যোগান দিতে হতো আগে, এখন উপকরণ ব্যবহার করতে হয় কিন্তু কোচিং, গাইড বই এর খরচ লাগে না। আগের শিক্ষাক্রমের শিক্ষার্থীরা সমস্যা মোকাবেলায় অপ্রস্তুত থাকতো, কিন্তু বর্তমান শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের নির্দেশনায় দলগত কাজের ফলে সৃষ্ট তাদের দলগত রসায়নের দ্বারা সমস্যা মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকার ক্ষমতা অর্জন করবে। শিক্ষার্থীরা বৈশ্বিক নাগরিক তৈরি হওয়ার মতো পরিবেশ পেতো না পূর্বের শিখনে, বর্তমানের শিখনে শিক্ষার্থী বৈশ্বিক নাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে ।

নতুন শিক্ষাক্রমের প্রধান বিষয় হলো, জীবনমুখী শিক্ষা। এখানে শিক্ষার্থী পড়ে শিখবে, জ্ঞান অর্জন করবে, হাতেকলমে দক্ষতা অর্জন করবে। ফলে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উন্নত দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হবে, উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হলেই শিক্ষার্থীর মূল্যবোধ সমৃদ্ধ হবে। ফলে এসব উপাদান অর্জনের সমন্বয়ে একজন শিক্ষার্থী যোগ্যতার ভিত্তিতে তার জীবনমুখী শিক্ষা অর্জিত করবে। এবং সবচেয়ে ইতিবাচক মুখ্য বিষয় হলো প্রতিযোগিতা নয়, শিক্ষা হবে সহযোগিতায়, সহমর্মিতায় ও আনন্দদায়ক পাঠের মাধ্যমে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধসবচেয়ে উষ্ণ বছর ২০২৩