প্রবাহ

কায়রো আল-আজহার ঐতিহাসিক মসজিদ ও জুমার নামাজ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১০ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:২৯ পূর্বাহ্ণ

কায়রো মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে আলআজহার ঐতিহাসিক মসজিদ। এই মসজিদ যেমনি বিশ্বখ্যাত তেমনি মসজিদ কেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ও। গত বছর ১৭ আগস্ট ইস্তাম্বুল থেকে কায়রো গমন করলে পরদিন শুক্রবার অতীব গুরুত্ব দিয়ে আলআজহার মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে যাওয়া হয়। ৯৭০ সালে আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২ বছরের ব্যবধানে ৯৭২ সালের ২২ জুন তথা ৭ রমজান শুক্রবার জুমার নামাজের মধ্য দিয়ে এই ঐতিহাসিক মসজিদের উদ্বোধন হয়।

তথা ৩৬১ হিজরি ৭ রমজান শুক্রবার জুমার নামাজের মাধ্যমে তৎকালীন ফাতেমীয় খলিফা আলমুইস এর নির্দেশে তার সেনাপতি জহুর ফাতেমীর তত্ত্বাবধানে এই আজহার মসজিদের যাত্রা শুরু হয়।

প্রথমে এটি মসজিদ রূপে প্রতিষ্ঠিত হলেও মাত্র ৩ বছরের ব্যবধানে আল ফরিদিকে প্রধান শায়খ নিয়োগের মাধ্যমে এটি আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। সেই সময় শিয়া সম্প্রদায়ের ইসমাইলিয়া মতবাদ প্রচারে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহৃত হলেও প্রায় ২ শত বছরের অধিক সময়ের ব্যবধানে ৮৮৯ হিজরিতে সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুভী মিশর বিজয় করার পর আলআজহারকে শিয়া প্রভাব মুক্ত করেন। সেই হতে আজ পর্যন্ত আলআজহার আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মতাদর্শে পরিচালিত হচ্ছে।

আধুনিক বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে আধুনিকায়নের লক্ষে প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের ১৯৬১ সালে আলআজহারকে জাতীয়করণ করেন এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেন। ফলে দেশবিদেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে আলআজহারের গুরুত্ব অনায়াসে বেড়ে যায়।

অবাক করা ব্যাপার ১৫ হাজার শিক্ষক, ১৩ হাজারের অধিক কর্মকর্তাকর্মচারী নিয়ে এ আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়। ১০৫ টিরও অধিক রাষ্ট্রের প্রায় ৪০ হাজারের অধিক বিদেশী শিক্ষার্থী দ্বীনেইলম ও জ্ঞানবিজ্ঞান শিখছে এখানে। আন্তর্জাতিকভাবে ধর্মীয় শিক্ষা প্রসারের লক্ষে শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা আছে এখানে।

আলআজহার এমন একটি বিশ্বখ্যাত প্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার জ্ঞান পিপাসুরা পাড়ি জমায়।

সাধারণত আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানকে ভাইসচ্যান্সেলর বুঝায়, রাষ্ট্রপতি পদাধিকার বলে চ্যান্সেলর। এখানে বলা হয় শায়খুল আজহার। শুধু তাই নয়, যিনি এই পদে নির্বাচিত হবেন তিনি দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হবেন। ১০৯০ হিজরিতে শায়খুল আজহার পদটি চালু হয়।

যারা এখান থেকে জ্ঞানার্জন করে বিশ্ববিদ্যালয়কে ধন্য করেছেন তৎমধ্যে হাদীস বিশারস আল্লামা ইমাম ইবনে হাজার ইন্তেকাল৮৫২, ইমাম সাখাবী ইন্তেকাল৬৪৩, ইমাম সুয়ুতী ৯১১, জাহেদ কাউসাচারীর১৩৭১ এর মত যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, মুফাস্‌িসর ও ফকীহ। আলআজহারু ফি আলফি আমিন এতে উক্ত বর্ণনাগুলো পাওয়া যায়।

আলআজহার শব্দের অর্থ বিখ্যাত বা জমকালো। আধুনিক ঐতিহাসিকগণের কারও কারও মতে যাহ্‌রা হযরত মা ফাতেমা (.) উপাধি প্রাপ্ত হওয়ায় তারই সম্মানার্থে মসজিদ এর নামকরণ করা হয়। হাজারের অধিক বছরের ইতিহাসে এ বিশাল মসজিদ প্রয়োজনের তাগিদে বারে বারে পুনঃ নির্মাণ ও পরিবর্ধন সাধন করতে হয়েছে।

ঐতিহাসিক ও প্রত্ন তত্ত্ববিদগণ গবেষণা করে আলআজহার মসজিদের মূল নকশা ও গঠন সম্মন্ধে ধারণা প্রদান করে গেছেন। আলআজহার মসজিদটি প্রায় আয়তকারের নকশায় নির্মিত হয়েছিল। এই মসজিদের উত্তরদক্ষিণ,পূবপশ্চিম ৮৪ মিটার করে।

মিশর ও তুরস্কে দ্বিতল মসজিদ দেখামেলা ভার। তুরস্কে মসজিদের অভ্যন্তরে তিন দিকে বড় বড় ব্যালকনি দেখা যাবে মহিলাগণের নামাজ পড়ার কল্যাণে। মিশরে তেমন চোখে পড়ে না। এই ঐতিহাসিক মসজিদটি বার বার পুনঃ নির্মিত হওয়ায় ইহার মূল অলংকরণও পরিবর্তিত হয়েছিল। তারপরও গবেষকগণ মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ফাতেমী খলিফাগণের আমলের কিছু কিছু অলংকরণ শনাক্ত করে গেছেন।

তথ্যানুসারে জানা যায়, খলিফা আবু আল আজিজ এই মসজিদের নতুন অংশ সংযোগ করেন এবং ইহার পূর্ববর্তী অংশও পুনঃ নির্মাণ করেন। খলিফা আল হাকিম ১০১০ সালে সংস্কার সাধন করেছিলেন। খলিফা আলমুসতানসির এই মসজিদের পুনঃ নির্মাণ করেন। খলিফা আলহাফিজ তার খেলাফতকালে মসজিদের সংস্কারে সজাগ থাকতেন। খলিফা সালাহ উদ্দিন ১১৭৩ সালে মসজিদের মেহেরাব সংস্কার এবং মিনার আরও সুউচ্চ করেন।

১৩০৩ সালে ভূমিকম্পে এই ঐতিহাসিক মসজিদের ক্ষতি সাধিত হয়। আমির সালাহ তা সংস্কার করেন। ১৩২৫ সালে কাজী মিজান, ১৩৪০ সালে আমির আকবুগার, ১৩৬০ সালে আমির বশির আলজমাদার, ১৪৬৯ সালে সুলতান কাইদ বাই, ১৫০১ সালে সুলতান আলগৌরি, ১৭৫২ সালে আমির ওসমান, ১৭৭৮ সালে ইব্রাহিম গওহর, ১৮৯২ সালে হেদিভ আব্বাস এই ঐতিহাসিক মসজিদকে নানানভাবে সংস্কারে অবদান রেখে গেছেন।

কায়রোতে ইমাম হোসাইন এর মস্তক মোবারক নিয়ে হোসাইনী মসজিদ, সৈয়দা জয়নাবের মাজার কেন্দ্রীক জয়নাব মসজিদ এবং এ আলআজহার মসজিদ অন্যতম প্রসিদ্ধ।

১৯৯৭ সালে রমজানের আগে আগে সপ্তাহখানের জন্য মিশর সফর করা হয়েছিল। তখন হোসাইনী মসজিদে জুমার নামাজ পড়েছিলাম। এইবারের সফরকালে জানতে পারলাম সৈয়দা জয়নাবের মসজিদে বড় ধরনের সংস্কার কাজ চলমান। ফলে আলআজহার মসজিদে জুমার নামাজ পড়বার সিদ্ধান্ত নিই। বাংলাদেশ ত বটেই চট্টগ্রামের অনেক ছাত্র উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।

আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র শায়েস্তা, জসিম, জালাল, আবু, কামাল ১৯৯৭ সালে ছাত্র ছিল। আজ চট্টগ্রামে তারা সসম্মানে স্বস্ব অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। শায়েস্তা খান পরামর্শ এবং নাম্বার দিলেন হাটহাজারী ফতেয়াবাদের জাহেদ এর। ফলে যাওয়ার আগে জাহেদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হয়।

১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টার্কিশ এয়ারে ইস্তাম্বুল থেকে কায়রো পৌঁছলে জাহেদ কয়েকজন বন্ধুসহ আমাদেরকে বিমান বন্দরে স্বাগত জানায়। আমরা নীল নদের পাড়ে বুক করা হোটেলে চলে আসি। জাহেদের সাথে পরামর্শ করে পরদিন শুক্রবার আলআজহার মসজিদে জুমা পড়ব সাব্যস্ত হয়। বাঁশখালী মিশকাতকে সাথে নিয়ে জাহেদ সকালে হোটেলে চলে আসে। আমরা টেক্সি নিয়ে হোটেল থেকে যথাসময়ে এই মসজিদে পৌঁছে যাই।

বস্তুতঃ একতলা বিশিষ্ট এই বিশাল মসজিদ নিয়ে কায়রো গর্ব করতে পারে। মসজিদের খতিব আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শায়খ ড. ইব্রাহীম আলহুদহুদ। খুবই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মনে হচ্ছিল, জুমার খোতবা খেয়াল করে। হাজারো নামাজীর সাথে এখানে নামাজ পড়ে খতিব সাহেবের হুজরার দিকে গেলাম সহযাত্রীসহ। আমাদের বিদেশী অতিথি বুঝতে পেরে দরজায় সম্মান দেখিয়ে ঢুকতে দিলেন।

মনে হচ্ছিল সরকারীভাবেও তার প্রটোকল রয়েছে। তিনি জুস নাস্তা দিয়ে আমাদের আপ্পায়ন করলেন। খোশ মেজাজে আলাপ করলেন। তুরস্কের উপর আমার রচিত গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ তাকে দিলাম। তিনি গ্রন্থের পাতা উল্টাতে উল্টাতে আমার সাথে আলাপ করতেছিলেন। অর্থাৎ সম্মানিত খতিব যেমনি ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন তেমনি বিনয় উদারতাও কাজ করছে তার মাঝে। জাহেদ, মিশকাত সহযাত্রী এডভোকেট ইলিয়াস, এমদাদ উল্লাহ, নুরুল ইসলামসহ আমরা ৪ জনকে নিকটে একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায় দুপুরের খাবার খেতে। অবশ্য তারা ছাত্র বিধায় যে কোন স্থানে আমরা টাকা প্রদান করতে সচেষ্ট থাকি। এ বিষয়ে তাদেরকেও নিষেধ করা আছে।

ইমাম হোসাইন (.) মাজার মসজিদ, সৈয়দা জয়নাব মাজার মসজিদ, আলআজহার মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটা ১ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে বলা যাবে। ১৯৯৭ সালে যেভাবে এলাকাকে সুন্দর পরিচ্ছন্ন অনুভব করেছিলাম, এখন কেন জানি এর ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। অর্থাৎ রাস্তায় ফুটপাতে হকারের আধিপত্য খোলামেলা পরিবেশ নেই বলা চলে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবচেয়ে উষ্ণ বছর ২০২৩
পরবর্তী নিবন্ধনির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে আমরা খুশি : জার্মান রাষ্ট্রদূত