দৈনিক আজাদী’র সাপ্তাহিক আয়োজন ‘আজমিশালী’র প্রথম বর্ষপূর্তি সংখ্যায় (১৯৯৮) সানজিদা মালেকের একটি লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। লেখাটিতে তিনি ‘আজমিশালী’ প্রকাশের উদ্যোগ থেকে নিয়মিত প্রকাশ হওয়ার বিভিন্ন বিষয়–আশয় উল্লেখ করেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি লিখেছিলেন (স্মৃতি থেকে লিখছি), “বাদল মামার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আজমিশালী কেমন হচ্ছে। মামা শুধু বললেন– ভালো। মামাটা এতো গম্ভীর কেন?” দেখতে গম্ভীর এই বাদল মামা হচ্ছেন দৈনিক আজাদীর কর্মাধ্যক্ষ (ম্যানেজার) মঈনুল আলম বাদল। যিনি আর এখন আমাদের মাঝে নেই। গত ৪ জানুয়ারি রাত আড়াইটায় তিনি না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। এমন ভালো মানুষটি এভাবে হঠাৎ করে সবকিছুর উর্ধ্বে চলে যাবেন; মানতেই পারছি না।
সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর তাঁর কক্ষে দীর্ঘক্ষণ কথা বললাম দুজনে। তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে আলাপ চালিয়ে নিচ্ছিলেন। সেদিন আলাপের মূল বিষয় ছিল বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি কালজয়ী উপন্যাস নিয়ে এবং উপন্যাসগুলোর বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রায়ন নিয়ে। এক পর্যায়ে জানালেন, বেশ কয়েকদিন তিনি বৈকালিক হাঁটা চালিয়ে যেতে পারছেন না। কোমড়ের ব্যথাটা বড্ড ভোগাচ্ছে। ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়েছে। আজ–কালের মধ্যে ডাক্তার দেখাবেন। এখন জানতে পারছি, তিনি ডাক্তার দেখিয়ে ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে চট্টগ্রামে ফিরে এসে ইমপেরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। ৫ জানুয়ারি সকালে ঘুম থেকে উঠে দৈনিক আজাদীর প্রথম পৃষ্ঠায় উনার ছবিটা দেখে বুকটা ধক্ করে উঠলো। সম্পূর্ণ খবরটা পড়ে শেষ করতে পারলাম না। কি হবে খবরটা শেষ পর্যন্ত পড়ে? তিনিই তো শেষ, নেই আর।
লেখার শুরুতে সানজিদা মালেকের যে সময়কার উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছি, সে সময় শ্রদ্ধেয় মঈনুল আলম বাদল গোঁফ রাখতেন। গোঁফ মানে গোঁফ– কর্ণেল ওসমানী স্টাইলে দশাসই ও দর্শনীয় গোঁফ। শালপ্রাংশু দেহ, স্বল্পভাষী, চেহারায় গাম্ভীর্য ও গোঁফের কল্যাণে তাঁকে বাহ্যিকভাবে অত্যন্ত গম্ভীর ও রসকষহীন ব্যক্তি মনে হওয়া যে কারো পক্ষেই স্বাভাবিক। কিন্তু যাঁরা তাঁর সাথে মিশেছেন, তাঁরা ভালোভাবেই জানেন, মঈনুল আলম বাদল সাহেব ছিলেন অত্যন্ত সরলমনা ও সাদাসিধে মানুষ। তাঁর অন্য অনন্য গুণাবলী হচ্ছে, অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ন, সৎ ও স্পষ্টবাদিতা। তাঁর এসব অনন্যসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বাইরে আমাকে আরও একটি বৈশিষ্ট্য বিমোহিত ও আকর্ষিত করেছিল। সেটা হচ্ছে তাঁর বিচিত্র বিষয়ে পঠনপাঠন এবং দেশ ও বিশ্ব রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য আহরণ।
তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ দর্শক। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের স্বর্ণালী সময়ের সিনেমাগুলো যেমন তাঁর দেখা ছিল, তেমন ইংরেজি ও হিন্দি সাড়া জাগানো প্রায় সব চলচ্চিত্র তাঁর দেখা ছিল। বাংলাদেশের মঞ্চ নাটক বিশেষ করে নব্বই দশক পর্যন্ত এবং টেলিভিশন নাটক (যখন একটিমাত্র চ্যানেল ছিল, বিটিভি) –এর তিনি একনিষ্ঠ দর্শক ছিলেন। তিনি সাংবাদিকতা করতেন না। কিন্তু গণমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমের যে–কোনো বিষয়–আশয় ও তথ্য–উপাত্ত ছিল তাঁর নখদর্পণে। ব্যক্তিগত কৌতূহল মেটানোর জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রশ্ন করে তাঁর কাছ থেকে সঠিক তথ্যটি জেনে নিতাম। তাঁকে চিনি প্রায় ত্রিশ বছর যাবৎ। কিন্তু তাঁর সাথে আমার আলাপচারিতা মাত্র কয়েক বছরের। এই অল্প কয়েক বছরে তিনি আমাকে কেমন আপন করে নিয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য, এরকম একজন মহৎ ব্যক্তির সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। আমাদের দুর্ভাগ্য, তাঁকে আমরা অকালে হারিয়ে ফেললাম।
২৪ ডিসেম্বর দুপুর দুইটা পার হয়ে গেছে। দুজন তাঁর কক্ষ থেকে বের হলাম চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী একটি বইয়ের দোকানের বর্তমান জৌলুসহীন অবস্থা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে করতে। প্রাসঙ্গিকভাবে এলো চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা দোকানগুলো নিয়ে অনুসন্ধানী লেখা প্রকাশের আকাঙ্ক্ষার কথা। চেরাগিপাহাড় মোড়ে ব্রাক ব্যাংকের সামনে বিদায় বেলায় তাঁর শেষ বাক্য “ভালো থাকবেন। আসবেন, কথা হবে।” ওপারে আপনি ভালো থাকুন মঈনুল আলম।
লেখক: নাট্যকর্মী ও শিক্ষক; সম্পাদক, নাট্যমঞ্চ।