নবান্নের শেষের দিকে ইশকুলের ছুটির ফাঁকে বন্ধুরা সবাই মাঠে ধান কুড়াতাম। সন্ধ্যাবেলা কুড়ানো ধানগুলো নিয়ে শীল পাড়ার শেফালী মা মাসি বাড়ি গিয়ে ধানের বিনিময়ে মোয়া–মুড়ি কিনতাম। সবুজ শ্যামল পাখি ডাকা ছায়া ঘেরা ছবির মতো আমাদের গ্রাম। পশ্চিমা বিল রাস্তার পাশে বিশাল বটবৃক্ষ। ইশকুলবেলায় শুকনো পাতা কুড়িয়ে আনতাম কমল মিয়া দাদুর জন্য। তিনি পাতাগুলো দিয়ে মাটির শানকিতে আগুন ধরিয়ে শরীর উষ্ণ করতেন। শীতকালে গলা খাঁকারি দিয়ে ভটভট করে হুঁকো টানতেন। ছোটবেলা দু ভাই মিলে হাসাহিস করে মাঝে মাঝে আমরা দু একটা কাঁশি দিতাম। শুকনো পাতার বিনিময়ে মাঝে মাঝে চারআনা দামের চকলেট কখনো–বা মাকড়সার ডিমের মতো বিস্কুট পেতাম।
হৈমন্তী বৈকালে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে ভরে যেত বাড়ির চারধার মাঠ ভরা ফসল। কিষাণ–কিষাণিরা ফসল তুলতে ব্যস্ত। কৃষকরা মেঠো পথ ধরে পাকা ধান কাঁধে নিয়ে ছুটত। সোনালি ধানগুলো নৃত্য করত। কী সুন্দর দৃশ্য। নতুন চাল ঢেঁকিতে না হয় হামান দিস্তায় ভাঙার শব্দ। সকালে গাছি মাটির কলসি কাঁধে নিয়ে রস লাগবি নি রস, খেজুর রস বলে হাঁক দিতেন। হেঁশেলে কাঠের চুল্লিতে আগুনে চিতই পিঠা–ভাপা পিঠা তৈরি হতো। ফুপু মায়ের পাশে গিয়ে বসে থাকতাম। তিনি চুল্লির মুখে বাঁশের চুঙ্গি দিয়ে ফুঁক দিতেন। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উড়ত মাঝে মাঝে খুক খুক কাঁশি দিতেন। গরুর গোবরের তৈরি ঘুঁটে অথবা ঘসি যা জ্বালানি বিশেষ মাঝে মাঝে শুকনো খড়–পাতা হিসেবে চুলোয় দিতেন। ধোঁয়া উড়ানো ভাপা পিঠা নামার সাথে সাথে খেজুর রসের বাটিতে খেতে দিতেন আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!
বয়স আর কত শিশু শ্রেণিতে পড়ছি। মা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের লালনপালনের দায়িত্ব পড়ে চেমনা ফুপুুর ঘাড়ে। ফুুপুর বাড়ি আর আমাদের বাড়ি পাশাপাশি। তিনি উঠোনে নতুন ধানের গাদা সাজিয়ে রাখতেন। গরু দিয়ে ধান মাড়াই হতো। ফুপু মা আমাদের কোলে নিয়ে সারাদিন কষ্ট করে মাড়াই ধানগুলো থেকে খড় পরিষ্কার করতেন। তাঁকে আমি মা বলে ডাকতাম। দরদি ফুপু মা আমাকে আপন সন্তানের মতো জানতেন। নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। কাক ডাকা ভোরে চুল্লিতে বনরুটি ডেনিস গরম করতেন। ফুপুদের একটা বেকারি ছিল সেলিম বেকারি। গোধূলিবেলায় ফুপা আব্বা বাড়ি ফিরতেন, তাঁর পাঞ্জাবির দু পকেটে সুইট বন ডেনিস চকলেট থাকত। আমি আর ছোটো ভাই মামুন মিলে ওনার পাঞ্জাবি টানটানি করে পকেট থেকে নাশতাটা নিয়ে মুখে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতাম। মাঝে মাঝে পাঞ্জাবির পকেট ছিঁড়ে যেত তবে তিনি কখনো রাগ করতেন না। ফুপু মা হাসিমাখা মুখে সুঁই দিয়ে সেলাই করে দিতেন। ফুপা এই দৃশ্যগুলো খুব উপভোগ করতেন আর মনে মনে হাসতেন। সহজসরল সদা হাসিমুখো ফুপা কত রসিকতা করতেন। চাকরির সুবাদে বাবার পোস্টিং কক্সবাজারে। বাবা–মা দুজনের স্নেহ আদর থেকে বঞ্চিত ছিলাম দু–ভাই। অবাক করার বিষয় ফুপা ফুপু এত ব্যস্ততার মাঝেও অকৃত্রিম ভালোবাসা, স্নেহ, মায়ামমতা দিয়ে আমাদের লালনপালন করেন। কালের বিবর্তনে কেন জানি আগেকার দিনের মতো অকৃত্রিম ভালোবাসা মায়ামমতা সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে। বছর ঘুরে আবার এলো হেমন্তকাল। খুব বেশি মনে পড়ছে ফুপু মা ও ফুপাকে। কোনো এক হেমন্তময় সকালে চিরতরে লুকোচুরি দিলেন অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রিয়জন ফুপু মা চেমনা খাতুন ও ফুপা আহমদ ছফা, আল্লাহ দুজনকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন–আমিন।