আওয়ামী লীগ এদেশের ইতিহাসের প্রতি পাতায় তার নাম অমোচনীয় অক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছে। এ কীর্তি এ দলের অর্জনের জন্য। আওয়ামী লীগ বাঙ্গালী জাতি সত্তার উন্মেষে, মনন গঠনে আর লক্ষ্য অর্জনে যে ভূমিকা পালন করেছে তা আমাদের ইতিহাসের দেদীপ্যমান এক সোনালি সোপান। এই উপ–মহাদেশে বহু জাতি সত্তা রয়েছে। যেমন ভারতে রয়েছে পাঞ্জাবি, মারাঠি, তামিল, বিহারী, গুজরাটি, নাগা, মিজো ইত্যাদি বহু জাতি সত্তা। একই ভাবে পাকিস্তানে পাঞ্জাবি, বালুচ, সিন্ধি ইত্যাদি। কিন্ত্তু এই সব জাতি সত্তার স্বতন্ত্র পরিচয় স্বাধীন সত্তা গড়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতিকে তার স্বতন্ত্র অবিধায় অবিষিক্ত করে একক এবং অন্যন্য এক ভূমিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ঐতিহ্যের অর্জনের গৌরবের আওয়ামী লীগ আজ এক কঠিন পরীক্ষার মুখামুখি নিজেকে দাঁড় করিয়েছে। ৭ জানুয়ারি ২০২৩ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের এ পরীক্ষার।
পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের উপর এক ধরনের মনস্ত্তাত্বিক চাপ তৈরী করেছে। সে চাপের মূল নাম অংশমূলক এবং ডাকনাম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অবাধ।
নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না হলে মূল বিরোধী দল বি এন পি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেয়। পশ্চিমা বিশ্বের চাপ বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের রীতিমত দৌড়ঝাঁপের উপর বিএনপি তাদের দাবী আদায়ে যথেষ্ট আস্থা স্থাপন করে বলে প্রতীয়মান হয়। আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক প্রভিশন অনুসারে নির্বাচন করতে অনড় অবস্থান নেয়। নির্বাচন বিএনপি বিহীন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত সব কটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন উপ–র্ন্বিাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল অনুল্লেখ্য। এমনকি গুলশান বনানীর উপ–র্ন্বিাচনে হিরো আলমের নানা সার্কাস আর ক্লাউনগিরিও আশানুরূপ ভোটারকে ভোট কেন্দ্রে টেনে আনতে ব্যর্থ হয়। চট্টগ্রামের ৮ এবং ১০ আসনের উপনির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য আরো তিক্ত অভিজ্ঞতা বয়ে আনে।
এমনই প্রেক্ষাপটে এবার আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাঠে নামতে হয়েছে। কিছু দোদুল্যমানতা কাটিয়ে অবশেষে জাতীয় পার্টিও নির্বাচনের মাঠে নামে। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য আসন ভাগাভাগিতে গিয়ে জাতীয় পাটি তাদের ভোটের মাঠের বিশ্বস্ততা অনেকটুকু হারিয়ে বসে। এতে তাদের ভাবমূর্তিও যথেষ্ট ম্লান হয়। এ ম্লান বদনে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে বলার শক্ত মাটি তাদের পায়ে নীচে নাই।
এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করে সম্ভবত পশ্চিমাদের এক হাত নিতে মনস্ত করে। ২৬ নভেম্বর ২০২৩ আওয়ামী লীগ স্বীয় দলের প্রার্থীতা আকাঙ্ক্ষী ৩,৩৬২ জনের সবাইকে গণভবনে ডেকে নেয়। এখানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মাননীয় প্রধান মন্ত্রী পার্টি নমিনেশন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রাথী হতে দলের নেতাদের কোন বাধা নাই বলে ঘোষণা দেন। ঘোষণাটি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত প্রায় সবাইকে উৎফুল্ল করে। অনেকেই মনে করতে থাকেন মনোনয়ন না পেলেও কি হবে স্বতন্ত্রভাবে ভোট করে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা বা নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে পারবেন। এই ভাগ্য পরীক্ষা বা জনপ্রিয়তা যাচাই করতে গিয়ে সারা দেশের ৩০০ আসনের প্রতিটিতে আওয়ামী লীগের নেতারা দাঁড়িয়ে গেছেন তার চির চেনা কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে প্রতি পক্ষের মুখোমুখি দাঁড়ানো সহযোদ্ধার বিপরীতে। সারা দেশে আজ আওয়ামী লীগের নেতায় নেতায় গৃহবিবাদের তাণ্ডব। সাধারণ মানুষকে সব সময় বলতে শুনেছি এবং আমি নিজেও অন্তপ্রাণ বিশ্বাস করি আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় সম্পদ, সব চেয়ে বড় গৌরবের জায়গা তার কর্মী বাহিনীর পার্টির প্রতি অবিচল অকুন্ঠ সমর্থন।
এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে একজন পার্টি মনোনীত নৌকা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বাকী স্বতন্ত্ররা ঈগল, কেটলি, বাঘ, সিংহ নিয়ে পার্টির প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রচারের ভাষা, বিষয় কোনটিই আওয়ামী লীগের জন্য সুখকর হওয়ার নয়। চট্টগ্রাম শহর এবং সংলগ্ন দু একটি আসনের অবস্থা আলোচনা করলে বিষয়টি খোলাসা হবে।
চট্টগ্রাম ৮ আসন দিয়ে শুরু করি। এই আসনে বিগত উপ–নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সজ্জন নিবেদিত প্রাণ একজন রাজনৈতিক কর্মী নোমান আল মাহমুদকে প্রার্থী করে এবং তিনি নির্বাচিত হন। এবারও তাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। ভাগাভাগির খড়গে নোমানের নমিনেশন কাটা পড়ে। জাতীয় পার্টি’র প্রাথীকে এ আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। এর পরও স্বতন্ত্র হতে বাধা নেই সূত্রে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা রয়ে যান বেচারা নোমান ছাড়া। এমনকি মহানগর আওয়ামী লীগের কোষধ্যক্ষও এখানে প্রার্থী, মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য বিজয় কিষাণও।
প্রথমে বিজয় কিষাণের পক্ষে প্রচারণা সভা করেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং নোমান আল মাহমুদ, দুই দিন পর মহানগর আওয়ামী লীগের দুই সহ সভাপতি জনাব খোরশেদ আলম সুজন এবং ইব্রাহিম হোসেন বাবুল সভা করেন জনাব আবদুচ ছালামের পক্ষে। এ থেকে সাধারণ কর্মীরা কী বার্তা পাচ্ছে? আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত।
চট্টগ্রম ১২ পটিয়ার দৃশ্যপট। শামসুল হক বর্তমান সাংসদ। মনোনয়ন বঞ্চিত। হুইপ। নিজ দলের কর্মীদের হাতে চরম লাঞ্ছিত। এখানে তার প্রতিপক্ষ দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোতাহার হোসেন। শামসুলের মামলায় ৫ আওয়ামী লীগ নেতা ইতিমধ্যে জেল হাজতে। বিভক্ত আওয়ামী লীগ সর্মথক পথে প্রান্তরে।
চট্টগ্রাম ১ মিরেরসরাই। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাবেক উপজেলা চেয়্যারম্যান। মাঠে আওয়ামী লীগের কর্মী বাহিনী পরিস্কার দ্বিধাবিভক্ত। লাটিসোটা নিয়ে পরস্পর মুখোমুখি।
চট্টগ্রাম ১৪ চন্দনাইশ। এখানে বর্তমান সাংসদ জনাব নজরুল ইসলাম। তার মুখামুখি উপজেলা চেয়্যারম্যান আরেক আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জব্বার। আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থকরা এখানেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে বিভক্ত।
চট্টগ্রাম১৫ সাতকানিয়া লোহাগড়া। বর্তমান সাংসদ জনাব আবু রেজা নদবী আর উপজেলা চেয়্যারম্যান জনাব মোতালেব মুখামুখি অবস্থানে। দুজনই বর্তমানে আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রাণকর্মী। উভয় প্রার্থী পরস্পরের দিকে রোষাণলের আগুন নিয়ে প্রচার যুদ্ধে এগিয়ে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম ৫ ফটিকছড়ি নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের নেতা মরহুম রফিকুল আনোয়ারের মেয়ে খদিজাতুল আনোয়ার সনি। ৩১ ডিসেম্বর ২৩ বাজারে জোর গুজব তার বদলে আওয়ামী লীগ সদ্য নিবন্ধিত “বাংলাদেশ সুপ্রীম পার্টি”র সাইফুদ্দিন মাইজভান্ডারীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ কর্মীদের অবস্থা “কোন দিকে যাব”।
চট্টগ্রাম ১৬ বাঁশখালী। বর্তমান সাংসদ জনাব মোস্তাফিজের মুখামুখি আরেক আওয়ামী লীগ নেতা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সহ সভাপতি জনাব মুজিবুর রহমান। এখানে আওয়ামী লীগের কর্মি সমর্থকদের অবস্থা রীতিমত সাপে–নেউলে।
পত্র–পত্রিকায় নজর দিলে দেখা যাবে চট্টগ্রামের বাইরে সারাদেশের দৃশ্যপটও প্রায় একই। সবখানে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ। ফরিদপুরে নিক্সন চৌধুরী – কাজী জাফরুল্লা, সিলেটে ব্যারিস্টার সুমন– বিমানমন্ত্রী, কিশোরগঞ্জ–১ আসনে সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলাম– ডাঃ সৈয়দ জাকিয়া নুর (দুজনই বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মরহুম সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান) বরিশাল– ৬ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হাফিজ মল্লিকের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল আলম চুন্নু, নারায়নগঞ্জ –১ আসনে গোলাম দস্তগীর গাজীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক উপজেলা চেয়্যারম্যান, শরীয়তপুর–২ আসনে নৌকার বিপরীতে প্রার্থী জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পীকার আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম শওকত আলীর ছেলে খালেদ শওকত, নোয়াখালি–৪ আসনে নৌকার একরামুল করিমের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি শিহাবউদ্দিন শাহিন। সব দেখে শুনে কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটা কিভাবে আমাদের হল’ কবিতার কয়েকটি চরণের কথা মনে হল :
কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান
মার্চের বিরুদ্ধে র্মাচ
হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি
শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে…
লেখক : কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক