চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রযোজনায় মনোজ মিত্রের বিখ্যাত নাটক কিনু কাহারের থেটারের বেশ কয়েকটি মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হলো চট্টগ্রাম, ঢাকা ও কক্সবাজারে। নাট্যকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিশিষ্ট নাট্যজন অসীম দাশের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় নাটকটির এ–পর্যন্ত ১০ টি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হলো যার ৭ টি চট্টগ্রামে, ২টি ঢাকায় ও ১টি কক্সবাজারে। এই নাটকে নাট্যকলা বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেছেন মঞ্চে ও নেপথ্যে। পুরো দলের সদস্য সংখ্যা ৪৫।
মনোজ মিত্র বাংলা নাট্য সাহিত্য ও নাট্যমঞ্চের প্রথিতযশা একজন রূপকার। ভারতের মতো বাংলাদেশের নাট্যপ্রেমীদের কাছেও তিনি সমাদৃত ও শ্রদ্ধাভাজন। তাঁর বিভিন্ন নাটক বাংলাদেশেও মঞ্চায়িত হয়েছে। চট্টগ্রামে মঞ্চায়িত হয়েছে সাজানো বাগান (গনায়ন, ১৯৭৮), পরবাস (অগ্রণী সংঘ, ১৯৮৬), নরক গুলজার (অগ্রণী সংঘ, ১৯৮৮)। মনোজ মিত্র তাঁর নাটকের দল ‘সুন্দরম’কে নিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে মঞ্চস্থ করে গেছেন তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘যাহা নাই ভারতে।’ এছাড়া তিনি নিজে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন নাট্যউৎসব ও সেমিনারে অতিথি হয়েও এসেছেন। চলচ্চিত্রের অভিনেতা রূপেও তিনি সর্বত্র আদৃত। সব মিলে মনোজ মিত্র যথেষ্ট সম্মানীয় একজন নাট্যব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ ও ভারতে। দুই দেশে তাঁর অনেক ছাত্র ও শিষ্য। তাঁর কিনু কাহারের থেটার যথেষ্ট দর্শকনন্দিত নাটক। চট্টগ্রামে এর পূর্বে প্রতিভাস নাট্যদলের প্রযোজনায় নাটকটি মঞ্চায়িত হয়েছে। সেই প্রযোজনাও বেশ ভালো। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রযোজনায় এবং অসীম দাশের নতুন ধরনের পরিকল্পনা ও সুসংহত নির্দেশনায় যখন আমরা নাটকটি দেখি, তখন পুরো প্রযোজনাটিই নতুন ও অভিনব মনে হয়। অসীম দাশ একজন মেধাবী ও সুদক্ষ নাট্য নির্দেশক। দিল্লির এনএসডির স্নাতকোত্তর অসীমের অনেক সফল নির্দেশনার দর্শক আমরা।
মনোজ মিত্রের নাটকে একটি প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক আবহ থাকে যা তিনি প্রহসন বা কৌতুক উপস্থাপন করেন। দর্শক চরম উপভোগ্যতার মধ্যে দিয়ে নাটকের অন্তর্নিহিত বক্তব্য ও গুঢ় সত্যকে খুঁজে নেন। কিনু কাহারের থেটারও তার ব্যতিক্রম নয়। মনোজ মিত্রের নাটকের মূল রসকে জারিত রেখে অসীম দাশ তাঁর নিজের নাট্যভাবনাকে উপস্থাপন করেছেন চমৎকার যূথবদ্ধ টিমওয়ার্ক এর সমন্বয়ে। বিষয়োচিত আলো, সংগীত (আবহ এবং সুরারোপ) এবং মঞ্চ পরিকল্পনার দায়িত্বেও ছিলেন তিনি যা সুচারুরূপে পালন করেছেন। নাটকের অভিনয়াংশও যথেষ্ট পরিণত ও দলবদ্ধ যা নাটকটিকে পুরো সময় ধরে ছিলেটান করে রাখতে সমর্থ হয়েছে। নাট্যকলা বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা নাটকটির প্রায় তিরিশিটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। মূল চরিত্র কিনু কাহার ও ঘন্টাকর্মের দ্বৈত চরিত্রে প্রাণবন্ত অভিনয় করেছেন আল মামুন। জগদম্বা চরিত্রটিতে নির্দেশক দুজন অভিনেত্রীকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন চরিত্রটির দুই ধরনের বৈশিষ্ট্য অনুসারে। জগদম্বা চরিত্রের দুটি শেড, গৃহানুগতা ও লোভী, এই দুটি শেডে যথাক্রমে চমৎকার অভিনয় করেছেন ‘অর্পিতা ভট্টাচার্য ও সানজিদা আমিন। বিশেষ করে অর্পিতার অভিনয় অনবদ্য। অন্যান্য চরিত্রে ইউনুস রানা (রাজা), আছাদ বিন রহমান (উজির), শামীম হোসেন নিশীথ (লাট সাহেব), উদাসিনী চরিত্রে মহাশ্বেতা দাশগুপ্তা ও উম্মে হাবিবা প্রমি। হিমাদ্রি শেখর রায় (ভদ্রলোক), মামুন খান (মৌনীবাবা); শাহ মো. মাহফুজার রহমান (পুলিশ) স্বত:স্ফূর্ত অভিনয় পুরো নাটকে প্রাণসঞ্চার করেছে।
এতগুলো চরিত্রের অভিনয়শিল্পী, বাজনদারের বড় দল এবং কলাকুশলী সব মিলিয়ে ৪৫ জনের বিশাল এক বাহিনীকে দারুণভাবে সামাল দিতে সমর্থ হয়েছেন নির্দেশক অসীম দাশ। অঙ্গরচনা ও পোশাক পরিকল্পনায় নাট্যকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদা সুলতানা তানজী দৃষ্টিনান্দনিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন। সেট ও প্রপ্স রচনায় বিভাগের অতিথি শিক্ষক অরূপ বড়ুয়া ও যথেষ্ট বিষয়ানুগ।
মনোজ মিত্রের এই নাটকের আখ্যানভাগ প্রায় শত বছর পূর্বের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও এখন সমসাময়িক। নাটকের প্রতিটি দৃশ্যে কিনুর বায়োয়ারি থিয়েটারের আদলে যে ঘটনাবলী আমরা দেখতে পাই তাতে সমকালের চিত্র প্রতিবিম্বিত হয় বেশ জোরালোভাবে। স্বার্থপর–দুর্নীতিবাজ রাজা উজির, বিদেশি শাসকের প্রতিনিধি (এখন রাষ্ট্রদূত), ভন্ড সাধু ও চেলা, বোকা ও অসহায় ঘন্টাকর্ণ, সাধারণ ও উচ্চাকাঙ্খী জগদম্বা, নির্যাতিতা উদাসিনী (এরা তিনজনই সাধারণ জনগণের প্রতিভূ) এসব চরিত্রগুলি আমাদের সকলেরই চেনা এবং এই চেনা চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে সেকাল ও একালের রাজনীতি, দুর্নীতি ও শোষনের চিত্র, উপভোগ্য কৌতুকাবহে নাট্যকার ও নাট্য নির্দেশক চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন।
ইংরেজ শাসনের শেষ দিকে কিনু কাহার নামের এক অন্ত্যজ যুবা যে তার বাপ দাদার পেশা বাদ দিয়ে হাটে বাজারে থিয়েটার করে বেড়াতো। অশিক্ষিত ও দরিদ্র গ্রামবাসীরাই ছিল তার থিয়েটারের দর্শক। সে একদিন ‘ঘন্টাকর্ণপালা’ নামের একটা নাটকের প্রদর্শনী করে। এই নাটকের কাহিনীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে কিনু কাহারের থেটার নাটকটি। ‘ঘন্টাকর্ণপালা’ নাটকটি ঘন্টাকর্ণ নামের সরল সাদাসিধে মানুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। যার সঙ্গে উঠে এসেছেন ক্ষমতাহীন ঠুঁঠো জগন্নাথ রাজা, তার দুর্নীতিবাজ ধুরন্ধর উজির ও সাঙ্গপাঙ্গ, বিদেশী রাজদূত, ভন্ড সাধু ও তার চেলা, নির্যাতিতা নারী উদাসিনী। এই চরিত্রগুলির সমন্বয়ে পুতনা নামের যে রাজ্যটির বিশৃঙ্খল চেহারা এ–নাটকে দেখানো হয়, সেটা আজকের বিশ্বের অনেক দেশের বাস্তব চিত্র। কিনু কাহারের থেটার নাটকটি কয়েক দশক আগে দেখা। অথচ এর প্রাসঙ্গিকতা এখনও সম্পূর্ণ বর্তমান। বিশ্ব রাজনীতির চলমান অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় শোষক ও শোষিতের এই খেলা চলতেই থাকবে যা অনেক আগে থেকেই চলছে।
সুন্দর, একটি নাট্যমঞ্চায়ন উপহার দেয়ার জন্য নির্দেশক অসীম দাশ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও বিভাগকে আন্তরিক ধন্যবাদ।