চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গতবার পাসের হার ছিল ৮০ দশমিক ৫০ শতাংশ। এবার জিপিএ–৫ পেয়েছে ৬ হাজার ৩৩৯ জন। গতবছর পেয়েছিল ১২ হাজার ৬৭০ জন। গতকাল রোববার দুপুর আড়াইটায় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ এ ফলাফল ঘোষণা করে। শিক্ষাবোর্ডের সম্মেলন কক্ষে ফলাফলের তথ্য উপস্থাপন করেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এ এম এম মুজিবুর রহমান। এর আগে সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে চলতি বছরে অনুষ্ঠিত দেশের ১১টি শিক্ষাবোর্ডের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলের সারসংক্ষেপ হস্তান্তর করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এসময় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও সকল বোর্ড চেয়ারম্যানবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এবার সারাদেশে গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে গত তিন বছরের তুলনায় এবার পাসের হার ও জিপিএ–৫ উভয়ই কমেছে। তুলনামূলক বিচারে ফলাফল ভালো না হওয়ার জন্য ‘পরিস্থিতি’কে দায়ী করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ফলাফল খারাপ হয়েছে এমনটি বলা যাবে না। গত তিন বছরের তুলনায় ‘কম’ হওয়ার পেছনে ‘পরিস্থিতি’ দায়ী। বিশেষ করে করোনাকালে পুরো সিলেবাসে পরীক্ষা না হওয়া ছাড়াও এবার চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরীক্ষা পেছানো এবং বন্যায় বহু ছাত্রছাত্রী লেখাপড়ার পরিবেশ হারিয়ে ফেলায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরে পাসের হার ৭৪ দশমিক ৪৫ হলেও আগের বছর পাস করেছিল ৮০ দশমিক ৫০ শতাংশ। এবার কমেছে ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ। আবার আগের বছর জিপিএ–৫ পেয়েছিল ১২ হাজার ৬৭০ জন পরীক্ষার্থী। এবার পেয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৩৩৯ জন। জিপিএ–৫ প্রাপ্তির সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। আগের বছরের তুলনায় পাসের হার এবং জিপিএ কমে যাওয়ায় কিছুটা আলোচনা হচ্ছে।
বোর্ডের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, গত চার বছরের মধ্যে এবারই প্রথম পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে সবগুলো বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছে। এর আগের তিন বছরের মধ্যে দুই বছর আংশিক সিলেবাসে এবং এক বছর পরীক্ষাই হয়নি। যে বছর পরীক্ষা হয়নি তখন অটোপাস দিতে হয়েছিল। ওই বছর শতভাগ পরীক্ষার্থী পাস হয়েছিল। সেটাকে স্বাভাবিক বিবেচনায় আনার সুযোগ নেই। ২০২১ কিংবা গত বছর আংশিক সিলেবাসে কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছিল। সেটাকেও স্বাভাবিক পরীক্ষা ধরার সুযোগ নেই। অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ছাত্রছাত্রীরা ফলাফল ভালো করার সুযোগ পেয়েছে। গত চার বছরের মধ্যে এবারই সবগুলো বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরফলে ওই বছরগুলোর তুলনায় এবার পাসের হার ও জিপিএ–৫ কমেছে। তবে স্বাভাবিক সময়ের স্বাভাবিক পরিস্থিতির তুলনায় এবার ফলাফল ভালো হয়েছে মন্তব্য করে বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালের পর এবারই স্বাভাবিক নিয়মে সবগুলো বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে পরীক্ষা হলো। এতে করে আগেকার ‘স্বাভাবিক সময়ের’ বিবেচনায় এবারের ফলাফল বিচার করতে হবে। ২০১৯ সালে পাসের হার ছিল ৬২ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং জিপিএ–৫ পেয়েছিল ২ হাজার ৮৬০ জন। ওই বছরের তুলনায় এবার ফলাফল অনেক ভালো হয়েছে বলেও তারা মন্তব্য করেন।
চট্টগ্রাম জেলার ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবার পাস করেছে ৬৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আগের বছরে এই হার ছিল ৭৬ দশমিক ১২ শতাংশ। বান্দরবানে এবার পাস করেছে ৬৬ দশমিক ৮১ শতাংশ। আগের বছর করেছিল ৮১ দশমিক ২০ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় এবার পাসের হার প্রায় ১৫ শতাংশ কমে গেছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, পরীক্ষা শুরুর মাত্র দিনকয়েক আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বৃহত্তর চট্টগ্রাম। এর ফলে ১৭ আগস্টের পরিবর্তে চট্টগ্রামে ২৭ আগস্ট থেকে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। পরীক্ষার শুরুর ঠিক আগে ১০ দিন পিছিয়ে দেয়ার ব্যাপারটিও কিছুটা প্রভাব ফেলেছে। সৃষ্ট বন্যায় শিক্ষার্থীদের বই খাতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তারা লেখাপড়া করার মতো কোনো পরিবেশই পায়নি।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র নাথ দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের বেশ সমস্যায় ফেলেছিল। বহু শিক্ষার্থী লেখাপড়া করা তো দূরের কথা ঘুমানোর জায়গাও পায়নি। নিজের বাড়িঘর ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকতে বাধ্য হয়েছে। সেখান থেকে পরীক্ষা দিয়েছে। তাদের বই খাতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই নতুনভাবে বই খাতা সংগ্রহ করে মানসিক কষ্টের মাঝে পরীক্ষায় বসেছিল। পরিস্থিতির শিকার হয়ে এসব শিক্ষার্থী প্রত্যাশিত ফলাফল করতে পারেনি বলেও তিনি জানান। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ এম এম মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আগের তিন বছরে করোনার কারণে এক বছর পরীক্ষা হয়নি, আবার শেষ দুই বছরেও পুরো সিলেবাসে পরীক্ষা হয়নি। এ কারণে আগের বছরগুলোতে ফল ভালো হয়েছিল। এবার পরিপূর্ণ সিলেবাসে সবগুলো পরীক্ষা হয়েছে। সেদিকে হিসাব করলে ২০১৯ সালের পরীক্ষার তুলনায় এবার পাসের হার বেড়েছে। তিনি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের ফলাফল খারাপ হয়েছে বলার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন।
এদিকে গতকাল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সাংবাদিক সম্মেলনে বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করে বলা হয়, ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষায় ২৭৯টি কলেজের ১ লাখ ৩ হাজার ২৪৮ জন ছাত্র–ছাত্রী অংশ নেয়। পাস করেছে ৭৫ হাজার ৯০৩ জন। পরীক্ষায় উপস্থিতির সংখ্যা ১ লাখ ১ হাজার ৯৪৯ জন। পাসের হার ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। পরীক্ষায় ছাত্রদের পাসের হার ৭১ দশমিক ২৪ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে ২ হাজার ৮৮৫ জন। ছাত্রীদের পাসের হার ৭৭ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পেয়েছে ৩ হাজার ৪৫৪ জন। তিনটি শাখার মধ্যে বিজ্ঞানে ৮৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৭৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং মানবিকে পাস করেছে ৬৫ দশমিক ২২ শতাংশ। শিক্ষাবোর্ডের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে ফলাফলের তথ্য উপস্থাপন করেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এ এম এম মুজিবুর রহমান। সাংবাদিক সম্মেলনে বোর্ডের সচিব অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র নাথ, কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক জাহেদুল হক, বিদ্যালয় পরিদর্শক ড. বিপ্লব গাঙ্গুলীসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।