আমাদের দেশে আগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের লুকিয়ে রাখা হতো। কিন্তু এখন বাবা–মা তাদের প্রতিবন্ধী সন্তানদের শিক্ষিত করে স্বাবলম্বী করার কথা ভাবেন। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদের বিশেষ উদ্যোগেই আজ প্রতিবন্ধীদের জন্য দেশে নানা কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে। বিভিন্ন খাতে তারা ভাতা পাচ্ছেন, বিভিন্ন বিষয়ে পুরস্কার পাচ্ছেন, অন্ধকার থেকে আলোতে আসছেন।‘
সায়েমা ওয়াজেদকে দেখলেই আমার মনে এক ধরনের স্বস্তি হয়। বিষয়টা এমন নয় যে তিনি প্রধানমন্ত্রী কন্যা বলে এই অনুভূতি কাজ করে। অনেক আগেই তিনি হৃদয় জয় করেছেন। তার সংগ্রামমুখর জীবন অটিজমের জন্য আত্ম নিবেদন অভূতপূর্ব। এসব শিশুর যে অভিজ্ঞতা বা তার ভেতর থেকে যে আহরণ তাকে সায়েমা ওয়াজেদ সবার কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছেন। পুতুল তার কথায় কতগুলো সাংঘাতিক অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। ছেলেবেলা থেকে তিনি জানেন তাঁরা নিজদেশে আশ্রয়হীন। তাদের মা বুকে পাথর চেপে কষ্ট সহ্য করে তাদের ভিনদেশে বড় করেছে । ট্রমা নামের যে বিষয়টি তাকে মর্মে মর্মে স্পর্শ করার সুযোগ বা দুর্ভাগ্য হয়েছিল তার। তার ভাষায় দিল্লীতে শরণার্থী জীবনের উদ্বিগ্নতা ভয় আর শংকায় বড় হয়ে ওঠা তিনি। বঙ্গবন্ধুর নাতনী হবার পরও দুর্ভোগ তাদের পিছু ছাড়ে নি। সবসময় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন একটি জীবন কেমন হতে পারে? সে জীবনেই কেটেছে তার ছেলেবেলা।
তিনি লিখছেন, বাড়িতে বাংলা বাইরে অনর্গল হিন্দি আর স্কুলে ইংরেজি শিখতে শিখতে বড় হবে ওঠা তার জীবনে হোলি দীপাবলি উৎসব ছিল নিত্য সঙ্গী । পরবর্তী কালে আমেরিকার ফ্লোরিডায় তরুণ বয়সে এশিয়ান ক্যারাবিয়ান ইউরোপিয়ান ও সাউথ আমেরিকান সংস্কৃতি তার জীবনে গভীর প্রভাব রেখেছে। সে ভাবেই গড়ে ওঠে তার মন ও মনন । এরপর আর কথা চলে না। সায়েমা ওয়াজেদকে নিয়ে আমার মতো মানুষের আগ্রহের আরো কারণ আছে।
রাজনৈতিক কলহ বা মতভেদের কারণে যারা শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার নিয়ে আজে বাজে মন্তব্য করেন তারা অন্ধ। সরল ভাবে দেখলে সায়েমার জীবনযাপন একেবারেই স্বাভাবিক। মনে আছে নিশ্চয়ই পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিন গিয়েছিলেন মায়ের সাথে। খোলা হাওয়ায় তার উড়ু উড়ু চুলের দিকে তাকিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্লিপ অথবা পিন বেঁধে দিয়েছিলেন তার চুলে। এতো সহজ ও সুন্দর দৃশ্য বাঙালির চিরন্তন ভালোবাসার দৃশ্য। এমন দৃশ্য তখন ই সম্ভব যখন আন্তরিকতা থাকে। স্নেহ থাকে ।
আমাদের দেশের নাম উজ্জ্বল করা তাকে দেখলেই ইন্দিরা গান্ধী ও বেনজিরের কথা মনে পড়ে। তারা ও একদিনে তৈরি হন নি। নেহেরু তাঁর একমাত্র সন্তান ইন্দিরাকে নানাভাবে প্রস্তুত করেছিলেন। জেলখানা থেকে লেখা নেহেরুর চিঠিগুলো ইতিহাসের অনন্য দলিল। সে সব পড়ে শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া করে যে মানবীর জন্ম তাঁর নাম ইন্দিরা গান্ধী। অন্যদিকে বেনজিরের জীবনেও তাঁর পিতার প্রভাব আছে। পিতার হাত ধরে রাজনীতি শুরু। পাকিস্তানের চরম বিপর্যয়ের পর ভুট্টো সিমলা চুক্তি সম্পাদনের জন্য ভারত গিয়েছিলেন , সে সময় তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন বেনজির। ইন্দিরাকে দেখা ও কথা বলার জন্য তার সাথে ভারত যাওয়া বেনজিরের কাহিনীতে সে সব কথা লিপিবদ্ধ আছে। কথাগুলো বললাম এই কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি আসবেন কি আসবেন না সেটা তার বা তাদের বিষয়। কিন্তু এলে আমার মনে হয় জাতিরই মঙ্গল।
সায়মা ওয়াজেদ ইতোমধ্যে আমাদের দেশ ও জাতিকে অনেক কিছু দিয়েছেন। বিশেষায়িত শিশুদের জন্য তার কাজ অসাধারণ। সবচেয়ে বড় কথা এই জায়গায় তিনি আমাদের দূত। আমাদের জাতির কন্ঠস্বর। ক দিন আগেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে জয়ী হয়েছেন। নেপালের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী শম্ভু পদ আচার্যকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। মোট দশ ভোটের মধ্যে তিনি আট ভোট পেয়ে জয়ী হন। এটা ইতিহাস, প্রথমবার এই পদটি কোন নারীর হাতে যাওয়া ও ইতিহাস।
অন্ধ রাজনীতি এসব চোখে দেখে না। গুণের কদর থাকলে সায়েমা ওয়াজেদকে মাথায় তুলে রাখতো দেশ। তিনি বলেন, তাঁর মা তাঁর আদর্শ কিন্তু তার কর্ম ও অভিজ্ঞতা বিবেচনার পরিবর্তে তাকে শুধু মায়ের মেয়ে হিসেবে বিবেচনা করাটা বৈষম্যমূলক। কথাটা সাহসী। কিন্তু সত্য। নিজের কর্ম ও অভিজ্ঞতায় বেড়েওঠা কন্যাটি আজ বিশ্বের নজর কাড়ছেন। সায়মা ওয়াজেদ ২০০৮ সালে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথমে বাংলাদেশে এবং পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় তিনি কাজ করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাকে ‘হু অ্যাক্সিলেন্স‘ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। সায়মা ওয়াজেদের উদ্যোগেই ২০১১ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় অটিজম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের পর গড়ে ওঠে সাউথ এশিয়ান অটিজম নেটওয়ার্ক। সংগঠনটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অটিস্টিক শিশুদের স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, সামাজিক মর্যাদা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সহায়তা দিতে অবকাঠামো গড়ে তোলে। প্রধানমন্ত্রীর কন্যার দেখাদেখি দেশের অনেক বিত্তবান এবং পরোপকারী মানুষ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুদের সহায়তায় এগিয়ে আসছেন; অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন এবং সেবা করছেন। প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, জনশক্তিতে পরিণত হচ্ছে।
মূল কথা হচ্ছে রাজনীতি আর কথার সমাজে এই নারী ব্যতিক্রম। খেয়াল করবেন সচরাচর খুব স্বাভাবিক আটপৌঢ়ে শাড়ি বা বস্ত্র পরিধান করেন তিনি। দেখলেই বোঝা যায় সহজ সরল। মমতা মাখানো মেয়ে হলে ও কাজের বেলায় মায়ের মতো দৃঢ়। এই দৃঢ়তাই তাকে এতটা পথ নিয়ে এসেছে। মনে রাখতেই হবে রক্তধারায় বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী, মা শেখ হাসিনা। পিতা একজন নামকরা বিজ্ঞানী। এমন পরিবারের মেয়েটি যে রত্ন হবে এটাইতো স্বাভাবিক। আমরা কদর জানি না। কদর করিও না। করলে দলমত নির্বিশেষে পুতুলের প্রতি মনযোগী হতো জাতি। আমাদের জীবনে নারীদের ভূমিকা সবসময় অবিস্মরণীয়। এই যে তো মৌলবাদের আস্ফালন তারপর ও নারী নেতৃত্বেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
বেগম রোকেয়া প্রীতিলতা জাহানারা ইমাম থেকে যে ইতিহাস দিন বদলের বাংলাদেশে সায়েমা ই হতে পারে আরেকজন পথিকৃৎ নারী। জীবনের যে সব অন্ধকার দিকে তিনি আলো ফেলছেন তার দিকে নজর না দিলে কোন জাতিই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। সায়েমা ওয়াজেদ আপনার জন্য রবীন্দ্রনাথের কথা থেকেই বলি: সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি।
রাজনৈতিক দলাদলি আর কলহের বাইরে দাঁড়িয়ে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখলে বোঝা সম্ভব একজন জীবন জয়ী জয়িতা সায়েমা ওয়াজেদ। এমন বীরকন্যা অপ্রগলভ পরিমিত নারী আমাদের দেশ ও দশের সম্পদ। কথিত রাজনীতি নেতাদের চাইতে যার অবদান অনেক বেশী। তার মতো নারীকেই আমরা ডাকি জয়িতা। যিনি আমাদের সবসময় এগিয়ে রাখছেন। জয়তু সায়মা ওয়াজেদ।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট