দেশের বীমা খাতের অবস্থা নাজুক হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সাধারণ বীমার অবস্থা খুবই খারাপ। ডলারসহ বৈশ্বিক সংকটে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই খাতটির এমন দুরবস্থা। ডলার সংকটে পণ্য এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় সাধারণ বীমার কার্যক্রম অর্ধেকে নেমে এসেছে। একসময় জমজমাট থাকা চট্টগ্রামের বীমা কোম্পানিগুলোর অফিসে গত কয়েক মাস ধরে কোনো কাজকর্ম নেই বলে সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, যে কোনো দেশের অর্থনীতির জন্য বীমা গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। দেশে দুই ধরনের বীমা কোম্পানি রয়েছে। সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা। সরকারি দুটিসহ দেশে মোট ৭৮টি বীমা কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ বীমা ৪৬টি এবং জীবন বীমা ৩২টি। সরকারি দুটি কোম্পানি ছাড়া বাকি ৭৬টি কোম্পানি খারাপ সময় পার করছে। জীবন বীমা বা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল। যে কোনো ব্যক্তি ইচ্ছে করলে বীমা করতে পারেন বা না করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ বীমার খাতগুলো বাধ্যতামূলক। এর মধ্যে যে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠা, কাঁচামাল বা পণ্য আমদানি, জাহাজ, গাড়ি কিনতে সাধারণ বীমা করতে হয়। এই বীমার সাথে ব্যাংকের এলসির সম্পর্ক রয়েছে। অপরদিকে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে সাধারণ বীমার বাধ্যবাধকতা। যে কোনো সিসি লোন করতে বীমা করতে হয়। কিন্তু এলসি ও সিসির পরিমাণ তলানিতে ঠেকায় সাধারণ বীমার গ্রাহকের পরিমাণ আশঙ্কাজনক পর্যায়ে কমে গেছে। ব্যক্তিগত যানবাহনের থার্ড পার্টি বীমা এই সেক্টরের বড় আয়ের উৎস ছিল। কারো কোনো কাজে না লাগায় সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে সাধারণ পর্যায়ে ভোগান্তি কমে গেছে। তবে সাধারণ বীমা খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সাধারণ বীমায় সবচেয়ে বড় ধসের সৃষ্টি করেছে ডলার সংকট। ব্যাংকগুলো এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করায় এলসির পরিমাণ কমে গেছে। এর সরাসরি ধাক্কা লেগেছে সাধারণ বীমায়। পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় সাধারণ বীমায় পলিসির সংখ্যা এত কমে গেছে যে, সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন ভাতার যোগান দিতেই হিমশিম খাচ্ছে বলে একাধিক বীমা কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তারা বলেন, আগের তুলনায় বীমার সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে।
গতকাল একাধিক বীমা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা বলেন, বীমা খাতে সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। ট্যারিফ রেট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে কমিশন ১৪.২৫ শতাংশের স্থলে কোম্পানিগুলো যেভাবে পারছে কমিশন ছাড়ছে। এতে এমন অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে যে, অনেক কোম্পানি ক্রমাগত ব্যবসা হারাচ্ছে। ১৪.২৫ শতাংশের স্থলে ৫০/৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন ছেড়ে ব্যবসা নেওয়ার চেষ্টা করে কোম্পানিগুলো। এরপরও ব্যবসা পাওয়া যাচ্ছে না। আমদানির জন্য এলসি না থাকার পাশাপাশি সিসি লোন না থাকায় বিভিন্ন কোম্পানির বড় বড় পার্টিগুলো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ বাহার উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ৩০/৩৫ শতাংশ পলিসি কমে গেছে। এলসি ও সিসি কমে যাওয়ার জন্য বর্তমান পরিস্থিতিকে দায়ী করে তিনি বলেন, বৈশ্বিক সংকট কেটে গেলে এই সেক্টরের সুদিন ফিরে আসবে।
দেশের ব্যবসা–বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রামে বিভিন্ন বীমা কোম্পানির অফিসগুলো একসময় জমজমাট থাকত উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বীমা কর্মকর্তা বলেন, এখন অফিসগুলো খাঁ খাঁ করে। তেমন কাজকর্ম নেই। আমদানি বাণিজ্যের সাথে জড়িত কর্পোরেট হাউজগুলোর অনেকে ঋণখেলাপি হয়ে গা ঢাকা দেওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে বীমা খাতের অবস্থা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। দেশের মোট জনশক্তির ৮ শতাংশের কম বীমা খাতের আওতায় এসেছে। জিডিপিতে এ খাতের অবদান মাত্র দশমিক ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। প্রতিবেশী দেশ ভারতে যা ৪ শতাংশের বেশি। ইংল্যান্ডের জিডিপিতে বীমা খাত ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, আমেরিকায় ৮ দশমিক ১ শতাংশ, জাপানে ৮ দশমিক ১ শতাংশ, হংকংয়ে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৭ শতাংশ ভূমিকা রাখে।
দেশের অর্থনীতিতে বীমার গুরুত্ব অপরিসীম বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই খাতের বিকাশে আরো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় বিদ্যমান দুরবস্থা থেকে এই সেক্টরকে রক্ষা করা কঠিন হবে।