দেশ হতে দেশান্তরে

রোলস রয়েস গারবেজ ভ্যান

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১২ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

কী বলছ বাবা ? একবারে ৭ টা রোলস রয়েসই কিনে ফেললেন?”

মহারাজা জয় সিংয়ের একবারে ৭ রোলস রয়েস কেনার গল্প শুনে, দু পুত্রই হাঁটা থামিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেও , কপালে চোখ তুলে ঐ প্রশ্নটি করেই নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দীপ , “হুম কিনতেই পারে , রাজা ছিল তো।“

তবে ঘটনা কিন্তু ওখানেই শেষ হয়নি বুঝলে? দুজনকে নিয়ে সামনে এগুতে এগুতে বলতেই, এবার উৎসুক জিজ্ঞাসা অভ্রর

তারপর কি হয়েছে ?”

মহারাজা জয় সিং তার কেনা ঐ সাতটা রোলস রয়েসই নিজের জন্য না রেখে, আলওয়ারের মিউনিসিপ্যালিটি দিয়ে বলে দিয়েছিলেন সেগুলো দিয়ে যেন শহরের ময়লা টানা হয় । মানে ওগুলোকে গারবেজ ভ্যান বানিয়ে দিয়েছিলেন উনি!

ওহ নো! তারপর কী হল?” তীব্র অবিশ্বাস দীপ্রর কণ্ঠেশোন তারপর হয়েছে কী, লন্ডনের রোলস রয়েসের হেড কোয়ার্টারে নাকি সে খবর পৌঁছে যায়। তাতে ওরা এক্কেবারে ভির্মি খেয়ে তাড়াতাড়ি মহারাজার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে টেলিগ্রাম করেছিল। সাথে বলেছিল ওরা রাজাকে আরো ৭টা রোলস রয়েস ফ্রি পাঠিয়ে দেবে। রাজা যেন রোলস রয়েস দিয়ে গারবেজ টানানো বন্ধ করেন। তাতেই নাকি রাজা শান্ত হয়েছিলেন।

ইজ ইট ট্রু ?” অভ্রর মুখ থেকে এবার এই প্রশ্ন আসতেই পড়ে গেলাম ধন্দে। কারণ এ গল্পের সত্যাসত্য তো জানি না নিশ্চিত। তদুপরি এই একই গল্পের সাথে মহারাজা জয় সিং ছাড়াও, হায়দারাবাদের নিজাম ও পাতিয়ালার মহারাজারা নামও শুনেছি। একই ঘটনা তিন তিন জনের সাথে ঘটতে পারে এরকম সম্ভাবনা খুবই কম। এছাড়া এ গল্পকে ওরা যেমন গুরুত্বের সাথে নিয়েছে, নিজে যখন ওই গল্প পড়েছি সেটিকে মোটেই গুরুত্ব দেইনি। গল্প কে গল্পের মতোই ভেবেছি । তদুপরি ভেবেছিলাম এটিকে ঐসব তুমুল বিলাসী রাজা মহারাজাদের খেয়ালি কর্মকাণ্ডের নজির হিসাবেই। তবে এটা ঠিক এ গল্প পড়ে মজাই পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, যাক যতোই ব্রিটিশ দখলদারদের তাবেদারি করে থাকুক না কেন ওরা, এইভাবে তো অন্তত একবার হলেও কঠিন শিক্ষা তো দিয়েছিলেন ব্রিটিশদের কেউ না কেউ একজন।

বলো না বাবা, এটা কি আসলেই সত্য?” অভ্রের প্রশ্নের কোন উত্তর না পেয়ে এবার প্রশ্ন এলো দীপ্রর কাছ থেকে।

আসলে এটা মনে হয় স্রেফ গল্পই। ব্রিটিশরা যে আমাদের খুবই অবজ্ঞা করতো, নিচু চোখে দেখতো এ কারনেই হয়তো কেউ না কেউ এই গল্পটা বানিয়েছিল। তবে একদম ঐ রকম না হলেও কিছু না কিছু তো হয়েছেই। ভারতবর্ষের ঐ রাজারা কিন্তু নিজেদের বিশাল কিছু মনে করতো। যেটা ব্রিটিশরা ভাল করেই জানত। তাই তারা ওদেরকে দিয়েই ভারতবর্ষ লুটপাট ও শাসন করতে করতে, পেছনে তাদের নিয়ে যতোই হাসাহাসি করুক সামনা সামনি কিন্তু তাদেরকে খুব সম্মান দেখাতো। আমার কিন্তু এমনও মনে হয়েছে যে, ঐ গল্পটা ব্রিটিশরাই চালু করেছিল, যাতে তাদের ব্যবসায়িরা বিশেষত যারা দামী জিনিশপত্র ভারতবর্ষে বিক্রি করতো তাদেরকে সাবধান করার জন্য। আগেই তো বলেছি এখন রোলস রয়েস জাতীয় গাড়ীর বড় মার্কেট মধ্যপ্রাচ্যে হলেও, সে সময় তা ছিল ভারতবর্ষে। বোজ না, ঐ রাজারা নাকি তাদের রোলস রয়েসের চাকার টায়ার ক্ষয় হয়ে গেলে, নতুন টায়ার না কিনে, নতুন আরেকটা গাড়ীই কিনে ফেলতো। সে যাক, আমি কিন্তু খুব খুশি হয়েছি যে, মজার গল্পটা শুনেই তোমরা বিশ্বাস করোনি। প্রশ্ন করেছ। এটা জরুরী বুঝলে। হউক না তিনি যেই, কেউ কোন কিছু বললেই তা বিশ্বাস করবে না সাথে সাথে। এমনকি কোন বইয়েও কিছু লেখা দেখলেই বিশ্বাস করবে না তা অন্ধভাবে!

আচ্ছা আমরা যাচ্ছি কোথায়? কিছুই তো দেখছি না এখানে। সেই থেকে কী গুঁজগুঁজ করছ বাপ বেটা তিনজন ?”

পেছন থেকে আসা লাজুর এ কথায় মনে হল, আরে তাইতো? নাহ, গল্প করতে করতে হাঁটলেও একদম কিছুই না দেখে হাঁটছিলাম তা তো নয়। হাঁটতে হাঁটতে দেখছিলামও রাস্তার এ পাশটা আনমনে। হ্যাঁ ঐ যে মিস ইনার কাছে শুনেছিলাম ধারেকাছেই আছে মেট্রো স্টেশন, সেটাই খুঁজছিলাম। যদিও নিশ্চিত করে বলেনি মিস ইনা যে রাস্তার এপাশেই পাওয়া যাবে সে স্টেশনটা , বরং আমারই কেন জানি স্থির বিশ্বাস হয়েছিল যে আছে ওটা এ পাশেই । সে জন্যই হোটেলের সেই বাগান পেরিয়ে এ পাশের রাস্তা ধরেই অনেকটাই এগিয়ে এসেছি। এমনকি ঐ যে ট্রাফিক সিগন্যালটার সাথে আছে যে জেব্রা ক্রসিং, যেটি পেরিয়ে যেতে হয় রাস্তার ওপাশের মল আর রেস্টুরেন্ট এলাকায় , সেটাও পিছু ফেলে এসেছি একটু আগে। কিন্তু নাহ এ পাশে গাছগাছড়াই বেশী । যে কটা দালান চোখে পড়েছে এপাশে সেগুলোকে দেখেও মনে হয়নি যে ঐখানে থাকতে পারে কোন মেট্রোস্টেশন। যে কটা রোড সাইন দেখেছি তাতেও ঐরকম কিছু নজরে পড়েনি। অতএব সামনে আর না এগুই। এ ভেবে থেমে, ঘুরে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম বউ আর বোনকে যে তাদের কারো চোখে পড়েছে কি না কোন মেট্রোস্টেশন?

ওমা , আমি তো জানিই না যে মেট্রোস্টেশন খুঁজছি আমরা !”

তুমি না বললে যে পেটশপ খুঁজতে বেরিয়েছ? এখন যে আবার বলছ মেট্রোস্টেশন? কী যে কখন বল ঠিক ঠিকানা নাই মাঝখান থেকে খালি খালি এই ঠাণ্ডায় এতোক্ষণ হাঁটালে “হেলেন আর লাজুর কাছ থেকে পর পর এই মন্তব্য আসাতে বোঝা গেল, ফেরারির দোকানে ঐ রকম অপমানজনক ঘটনার মুখোমুখি হয়ে , মাথায় যে আগুন ধরে গিয়েছিল তাতে মাথা যাকে বলে আউলা হয়ে যাওয়া, তা হয়েছে। অতএব ওদেরকে হোটেলের ভেতর থেকে পুত্ররা ডেকে আনার পরও পরিষ্কার করে কিছু না বলে,ধরেছিলাম হাঁটা এইদিকে নিজমনে মেট্রোস্টেশন খোঁজার সঙ্কল্পে। তাতে ইংরেজিতে যাকে বলে কমিউনিকেশন ব্রেক ডাউন হওয়া, তাই ঘটেছে। যতোই বেইজিংহিম আজ কম থাকুক কিম্বা বেড়ে থাকুক এ ক’দিনে সেটিকে সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের, তারপরেও অকারনে এভাবে এই হিমে হাঁটা তো বাঙ্গালের কর্ম না।

ফলে নির্দ্বিধায় দায় মাথা পেতে নিয়ে বললাম, হুম ভুলটা আমারই হয়েছে। রাস্তার এ পাশে আসলে কিছুই নাই, চল যাই ঐ পাড়ে। অভ্র যে পেটশপ খুঁজে বের করেছিল গুগল করে , তার কাছে ধারে একটা মেট্রোস্টেশন আছে। পেট শপ বললে মিস ইনা যদি না বোঝে তাই তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কাছে ধারে কোন মেট্রোস্টেশন আছে কি না। তার কথা শুনে মনে হয়েছিল কাছে ধারেই আছে ওটা রাস্তার এ পাশেই। এখন মনে হচ্ছে না, তা না। কিন্তু এতক্ষণ যে দেখলাম তাতে রাস্তার এ পাশের হাবেভাবে মনে হচ্ছে , আছে যা কিছু ঐ পাশেই । আজকে তো আমাদের হন্টনদিবস, না তা অবশ্য না। আজ হল শপিংদিবস। শপিং করবো আজ আশপাশের মল গুলোতেই হেঁটে হেঁটেই। তবে এখন চল প্রথম অভ্রর সেই পেটশপই খুঁজে বের করি আগে এসব বলতে বলতে সদলবলে দিলাম ফিরতি হাঁটা সেই জেব্রাক্রসিং এর দিকে।

এখন কি দোকানপাঠ খোলা পাওয়া যাবে?” পিছু ফিরতে ফিরতে করা হেলেনের এই সন্দেহমাখা প্রশ্নে বুঝলাম যতোই বাজুক না কেন এখন সাড়ে দশটা বা এগারোটা, এখনো যেহেতু সুয্যি মামা পা ফেলেননি বেজিং শহরের বুকে , রাস্তা ঘাট সবই আছে তাই ধোঁয়াশায় ঢাকা। রাস্তায় বেশ গাড়ীর চলাচল থাকলেও চারিদিকের ভাবে সময়টাকে ঢাকার শীতের সকালের সাতটা আটটার মতোই মনে হচ্ছে। তদুপরি ঢাকার রাস্তায় ঐরকম সকালেও বেশ অনেক লোকজনই নানান কারনে পায়ে হেঁটে গেলেও এখানে আমরাই হলাম একমাত্র হন্টনযাত্রী। ফলে ওর কাছে সন্দেহ হচ্ছে যে, নিশ্চয়ই এখনো দোকানপাঠ খুলেনি।

আমার ধারণা খুলেছে। দেখাই যাক না। যাই তো আগে ঐ পাশে। বন্ধ থাকলেও ঐ পেটশপ টা খুঁজে পেলেই হবে। চিনে রাখব। তারপর সময় করে পরে আবার যাবো। কি বল বাবা? বলে অভ্রকে চাপড় দিতেই হাসল ও ফিক করে।

না, কপাল ভালই বলতে হয়! আনমনে গল্পে গল্পে মেট্রোস্টেশন খুঁজতে খুঁজতে, সেই ট্রাফিক সিগন্যালসংলগ্ন জেব্রা ক্রসিং থেকে, খুব বেশীদূর যাইনি এগিয়ে। খুব দ্রুতই তাই এসে দাঁড়িয়েছি সেই জেব্রাক্রসিংয়ের লেজে। তদুপরি বেশীক্ষণ অপেক্ষাও করতে হল না। অচিরেই পদব্রজে রাস্তা পার হবার সাইন মানে হন্টনরত মানুষের ছবি ভেসে উঠলো ট্রাফিক লাইটে। দ্রুত সদলবলে জেব্রাক্রসিং পেরিয়ে, রাস্তার এ পাশে দাঁড়িয়ে সবাইকে বললাম, প্রত্যেকে রাস্তার এ পাশটা যেন গভীর মনোযোগে দেখে। যাতে কোনমতেই কারোই চোখ এড়িয়ে পার হয়ে না যাই সেই মেট্রোস্টেশন। এরই মধ্যে রিজেন্ট হোটেলের কার্ড থেকে জেনেছি, আছি বেইজিং এর ডংচেং ডিস্ট্রিক্টের জিনবাও রোডে। এখানের আশেপাশেই আছে একটা মেট্রোস্টেশন।

এদিকে এপাশের নানান স্থাপনাগুলোতে চোখ রেখে এগুতে এগুতে, চায়নায় পা দেবার পর থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাপ্রসূত ধারনাটি পোক্ত হল আরো। গত দুই তিনদিনের রাতের বেলায় এ পাশটা দিয়ে একাকী এবং সদলবলে বেশ কয়েকবার গেলেও, এখানকার সব কিছু খুঁটিয়ে দেখা হয়নি তখন। দেখছি যা এখন। তাতে ফের মনে হল, নাহ চায়না বা বেইজিং এখনো ভ্রমানিকবান্ধব হয়ে উঠে নি। একদিকে আছে কথা বলতে গেলে ভাষাগত বিভ্রাট। অন্যদিকে এখানকার মানুষেরা অন্তত আমাদের মতো ভ্রমানিকদের ব্যাপারে একদমই নিরাবেগ ও নিরুৎসুক। এখন দেখছি ছোটবড় মিলিয়ে যতো সাইনবোর্ড তার সবই চায়নিজ! তারপরও হাল না ছেড়ে দেখছি ওগুলোই। মনে আশা থাকে যদি কোন ছবি বা চেনা সঙ্কেত ওসবে। সে মোতাবেক একদিকে যেমন দেখছি সেই স্টেশনটির সাইন, সাথে খুঁজছি এমন কোন সাইনবোর্ড যাতে আছে কি না কুকুর বিড়াল বা পাখির ছবি, যা দেখে বোঝা যাবে যে ওটা একটা পেটশপ।

বাবা, বাবা ঐ যে দেখো ঐ যে একটা আন্ডার পাস মনে হচ্ছে। ওটাতে ঢুকলে কি পাওয়া যাবে নাকি সেই স্টেশনটা?“ বেশ উত্তেজিত গলায় এসময় বলে উঠা দীপ্রর তর্জনী নির্দেশিত দিকে তাকাতেই, চোখে পড়লো এইমাত্র পিছু ফেলে আসা সুড়ঙ্গের মুখটি।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি সামাজিক ব্যাধি
পরবর্তী নিবন্ধশ্রীশ্রী কালী পূজা : একটি সারসংক্ষেপ