আমরা ইভটিজিং নিয়ে কথা বলি, স্যোশাল মিডিয়ার ট্রল নিয়ে হইচই বাঁধিয়ে ফেলি। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগিং নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করি। কিন্তু আমরা পারিবারিক ট্রল নিয়ে ভেবেছি কখনো? না ভাবিনি। আমাদের মাথায় এই ভাবনাটাই হয়তো কখনো আসেনি। অথচ দেখা যায় প্রায় ঘরের কোনো না কোনো সদস্য ট্রলের শিকার হচ্ছে পারিবারিকভাবে।
ধরুন আপনার বাড়ির সদস্যদের ভেতর একটি মেয়ে বেশ চঞ্চল। হয়তো তারভেতর একটু ছেলেমানুষি বেশি। অন্য সবার মতো এত ভাব–গাম্ভীর্য নিয়ে সে চলতে পারে না। হয়তো কথায় কথায় হাহা–হিহিতে চারপাশ সরগরম করে রাখে। তখন এই চঞ্চল মেয়েটি পাগলি নামক একটি উপাধি পেয়ে থাকে। দেখা যায় তারই পরিবারের সদস্যরা মেহমানদের সামনে বলতে থাকবে, ওতো একটা পাগলি। কেউ বলবে ও আমাদের একটা পাগল। ধীরে ধীরে পাড়া প্রতিবেশি থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজনও বলতে থাকবে ওতো একটা পাগলি। হয়তো সবার কাছে পাগল পাগলি একটা আদরের ডাক কিন্তু মেয়েটার কাছে এই শব্দটি কেমন লেগেছে, সে কীভাবে নিচ্ছে কেউ একবারও ভেবে দেখেনা। একসময় এই ডাকটি তার জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। যখন সে পরের ঘরে যায়। তার শ্বশুর–শাশুড়ি ননদ দেবর জা সবার সামনে হয়তো কেউ বলে বসেছে ও আমাদের পাগলি। ব্যাস হয়ে গেছে সের এর উপর সোয়া সের। মনে করেন বাকি জীবন শ্বশুর বাড়িতে এই তকমা তার কপালে লেগে গেল। এবার আসুন স্বামী মহাশয়ের কাছে। তিনি দেখলেন, তার স্ত্রীকে সবাই এই পদবী ধরেই ডাকছেন মজা করে হোক আর কিছু না ভেবেই হোক। ব্যাস হয়ে গেল স্বামীর বাকি জীবনের বৌকে বদ করার চরম অস্ত্রখানা। ঝগড়া লাগলেই, তুমি তো একটা পাগল। তোমার বাড়ির লোক, আত্মীয়স্বজন সবাইতো তোমাকে পাগল বলেই জানে। হয়তো এই শব্দটি দুজনের ভেতর সম্পর্কের ফাটল ধরার উত্তম ইস্যু।
এরপর আসুন বাড়ির একটি ছেলে বেশ সহজসরল। হয়তো পড়াশুনার চেয়ে খেলাধুলায় মনোযোগী বেশি। হয়তো একটু বোঝে কম, ম্যাচুউরিটি একটু কম। তখন শুনতে হয় আরে ওতো একটা বেকুব। মাথায় কোনো বুদ্ধিসুদ্ধি নাই, অথর্ব একটা, কাম চোর, পড়ালেখায় গোবরগণেশ, বলদ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা একবারও ভেবে দেখিনা এই ছেলেটার কেমন লাগছে। ভাইটার মনে কেমন দাগ কাটছে। যখন এই ছেলেটা বিয়ে করে বৌ নিয়ে আসে। তখন ওই বৌয়ের সামনে তার নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয়া, সে কতটা বেকুব তার বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরা এবং সেটার প্রমাণ দেয়া। যখন একটা ছেলে বা মেয়ে বুঝে তার জীবনসঙ্গীটি তার পরিবারের কাছে মূল্যহীন, অবহেলিত, দুর্বল তখনই ওই স্ত্রী তাকে অবমূল্যায়ন করা শুরু করে এবং অমর্যাদাকর আসনে অধিষ্ঠিত করেন। এভাবেই অনেক সংসারের ভাঙন ধরার মুল চাবিকাঠি এই পারিবারিক ট্রল। আর যদি বাড়ির কোনো সদস্যের গায়ের রঙ কালো বা শারীরিক প্রতিবন্ধী তাহলে তো আর কথাই নেই। কালি, লেংড়া, আন্ধা কানা নানা শব্দে তাদের ভূষিত হতে হয়। তারপর ধরুন একটি মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে দু’চোখ ভরে রঙিন রঙিন স্বপ্ন নিয়ে যায়। দেখা যাবে তাকে ছোট করার জন্য অযথাই হাসিঠাট্টা। তাকে নিয়ে বিরক্তিকর কথাবার্তা। কারণ ছাড়াই খোঁচাখুচি। ঠেস মেরে কথা বলা। এক বৌমার সাথে আরেক বৌমার তুলনা করা। এভাবে দিনের পর দিন শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা সহ্য করা। হয়তো কেউ বাপের বাড়িতে বলে প্রশ্রয় পায় না বলে মুখ বুজে সব সহ্য করে যায় নীরবে।
আর ছেলেদের ক্ষেত্রে দেখা যায় পকেট দুর্বল মানেই শ্বশুর বাড়িতে সম্মান কম। পকেট ভারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জামাইকে মাথায় তুলে নাচে আর দুর্বল পকেটওয়ালাকে ধুলায় লুটায়। বয়সে ছোট হলেও দেখা যাবে তার খাতিনদারি থাকে আলাদা। টেবিল ভর্তি খাবার দাবার। আবার সেই ছেলের বাড়ির লোকদের কদরই থাকে অন্যরকম। ভিআইপি কদর যাকে বলে। আর দুর্বল পকেটের জামাই আদর? শ্বশুরবাড়িতে ঢুকতে পারছে, সবার সাথে বসে খেতে পারছে এটাই তাদের কাছে মনে করেন অনেক সম্মান দেয়া তাকে হয়ে গেছে। মুখের উপর ঠাস ঠাস করে কথা বলে অপমান করতেই যেন আলাদা আনন্দ পায় কেউ। এইযে সম্পর্কের ব্যবধান এটা কারোরই হয়তো চোখ এড়ায় না। তারপরেও সবাই স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেয়। কিন্তু মেয়ে এবং মেয়ের জামাই বা বোন এবং বোনের জামাইর বুকের ভেতর কষ্ট নামে একটি শব্দ ঝনঝন করে ব্যথা বলে উঠে। একটা সময় দেখা যায় তাদের ছেলেমেয়ে এবং ছেলের বৌ, মেয়ের জামাইদের কাছ থেকে অবহেলিত হয়ে আসে। এভাবে অবহেলা পেতে পেতে অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে একসময় তারা জীবন থেকে অবসরে চলে যান শেষ ঠিকানায়।