বাংলাদেশের এক আত্মস্বীকৃত সুন্দরী সম্প্রতি তাঁর কারণে ক্রিকেট খেলোয়াড়দের স্ত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন বলে সদম্ভে ঘোষণা দিয়েছেন। একটি প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকে তাঁর নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকারের সঙ্গে সংযুক্ত একগুচ্ছ আবেদনময় স্থিরচিত্র দেখে প্রথমেই তাঁকে বলিউডের কোন অপরিচিত অভিনেত্রী বলেই মনে হয়েছিল, যদিও তাঁর কাজ দেখার সুযোগ বা সৌভাগ্য এখনও হয়নি। তার সেই অমূল্য সাক্ষাৎকারও পড়া হতো না যদিনা ‘ক্রিকেটারদের স্ত্রীরা আমাকে নিরাপদ মনে করে না, এটাও তো মানতেই হবে, আমি অনেক সুন্দরী’– এমন ভয়ংকর শিরোনামটি চোখে পড়ত। এই একটি বাক্য বলে দেয়– তার ভাষায়, তার প্রধান শক্তি ও অবলম্বন কিংবা বলা যায় প্রধান অস্ত্র তার সৌন্দর্য তথা রূপ–যৌবন; সোজা কথায় তাঁর ত্বক ও দেহ।
সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় তিনি খেলার মাঠে মাইক্রোফোন হাতে খেলোয়াড়দের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁকে খেলোয়াড়দের কাছাকাছি যেতে হয়। ভয়ংকর রকমের রূপবতী একজন নারী আশেপাশে ঘুরে বেড়ালে পুরুষ খেলোয়াড়দের পা পিছলে যাওয়ার, কিংবা হৃদয়ে ঝড় উঠার আশংকা থাকে। খেলোয়াড়দের স্ত্রী–দের ভয়টা ওখানেই। এমন অশোভন ও আপত্তিকর একটা বিষয় যাকে একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীর প্রতি ‘অপবাদ’ হিসেবেই বিবেচনা করা যায়, তা–ই নিয়ে গর্বিত তিনি। খেলোয়াড়দের স্ত্রীদের নিরাপত্তাহীনতার কারণ হয়ে আত্মতৃপ্তিতে বুঁদ হয়ে আছেন সেই আত্মস্বীকৃত সুন্দরী।
না, রূপালি পর্দায় হঠাৎ ঝড় তোলা কেউ নন তিনি, তবে কয়েকটি নাটকে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ। তিনি কিন্তু অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত বা নিতান্ত অল্পবয়সী যেন–তেন কেউও নন। তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত নারী, একজন চিকিৎসক, নামী–দামী চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক, সর্বোপরি সন্তানের জননী। তাঁর সন্তান রাজধানীর আরেক নামী–দামী বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। উচ্চবিত্ত ও সংস্কৃতিবান পরিবারের সদস্য তিনি– একথা নির্দ্বিধায় বলাই যায়; এক কথায় একজন সফল নারী। এমন একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নারীর গৌরব তাঁর পাণ্ডিত্যে, প্রজ্ঞায়, ব্যক্তিত্বে। লক্ষ মেয়ের অনুপ্রেরণাদানকারী, ‘রোলমডেল’ হওয়ার যোগ্য তিনি। অথচ তিনি গৌরবান্বিত ক্রিকেটারদের স্ত্রীদের স্বস্তি কেড়ে নিতে পেরে। নারী হয়ে নারীদের ত্রাস হওয়াতেই জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছেন তিনি! এই যদি হয় উচ্চশিক্ষিত নারীর ভাবনা, তবে তো শিক্ষার শক্তি, সৌন্দর্য ও দর্শন নিয়ে নতুন করে গবেষণা করতে হয়। বেগম রোকেয়া অবরোধবাসিনী নারীজাতির দিন ফেরাতে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে বলেছিলেন। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজটাকে জাগাতে শিক্ষা প্রসারের জন্য আমৃত্যু যুদ্ধ করে গিয়েছিলেন তিনি। অথচ আজকের উচ্চশিক্ষিত নারীর আচরণ বড় নির্মম ও নির্লজ্জভাবে সামাজিক অগ্রগতি, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতি আঙুল তুলছে।
বড়ই আক্ষেপের বিষয়, শারীরিক সৌন্দর্যের আবেশ ছড়িয়ে সভা সমিতির সৌন্দর্য বর্ধন করার জন্য যে নারীর জন্ম হয়নি সে উপলব্ধি সমাজে আজও আসেনি; না পূর্বে না পশ্চিমে। আর সেকারণেই স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহাসমাবেশে অধিকাংশ নারী আজও আলো ছড়ায় দৈহিক সৌন্দর্যের বিজ্ঞাপন করে, যদিও শিক্ষাদীক্ষায় তারা কোনোদিক দিয়েই পিছিয়ে নেই। গণমাধ্যমে একজন সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী নারীর প্রতিকৃতি সাক্ষ্য দেয়– তার কৃতকর্ম নয়, কোনো কৃতিত্বের সনদ নয়, বরং দেহের অনাবৃত অংশবিশেষ ও আবেদনময় পোশাকই তার শক্তিমত্তার পরিচায়ক। সংবাদকর্মী ও ছবিওয়ালারা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে তাঁদের পেছনে, একটা যুৎসই ছবির আশায়। একই আসরে পুরুষের পোশাক নিয়ে কিন্তু কোনো মাতামাতি হয়না, দু’পাতা লেখাও হয় না। তবে কি পুরুষ নারীর চেয়ে কম শক্তি ও সাহসের অধিকারী? তথাকথিত সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী নারীদের আগমনে অশ্লীলতার জোয়ার বয়ে যায় লাল গালিচায়। শিল্পের নামে উচ্চ প্রশংসা জোটে আবেদনময়ী নারীদের ঝুলিতে। বিশ্বমঞ্চে ঐতিহ্য উপস্থাপনের নামে ঐতিহ্যের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে ধন্য হয় বাঙালি নারীও।
তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, নারীর শক্তির উৎস আসলে কোথায়? শারীরিক সৌন্দর্যে না কি শিক্ষায় ? শিক্ষার শক্তিইবা কোথায়? ভারী ভারী সনদে না তার আচরণ ও তার কার্যকরীতায়? আগেই বলা হয়েছে গণমাধ্যমে শক্তিময়ী ও সাহসী নারীদের যেসব ছবি দৃশ্যমান হয়, তাতে আবেদনময়তার আধিক্যই পরিলক্ষিত হয়। বলাবাহুল্য এটা পশ্চিমেরই প্রভাব। বিশ্বায়নের যুগে পশ্চিমের প্রভাবকে রোধ করা সম্ভব নয়, যেমনি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় মুঠি মুঠি রিয়াল দিরহাম, দিনারের সঙ্গে চলে আসা আরব দেশীয় সংস্কৃতিকেও। আমার শিক্ষাই পারে আমাকে শেখাতে আমি কি অন্ধভাবে অন্যকে অনুকরণ করে যাব, না স্বকীয়তাকে সমুন্নত রাখব। পারিবারিক মূল্যবোধ, দেশীয় কৃষ্টি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আচরণবিধি ও পোশাকই একজন নারীর শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের পরিচয় বহন করে।
শুধু কি শিক্ষিত নারীই শক্তিময়ী ও সাহসী নারী? গৃহকর্মী, পোশাক–শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিকসহ অসংখ্য শ্রমজীবী প্রান্তিক নারীদের শক্তি ও সাহসের গল্প কিন্তু বলে শেষ করার নয়। শৈশব থেকেই পারিবারিক, আর্থ–সামাজিক, প্রাকৃতিক নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে নারী হয়ে ওঠে তারা। ওদের জীবনে প্রেম আসে না, সাফল্য ধরা দেয় না, আনন্দ থাকে অধরা। নাগরিক সুবিধার বিন্দুমাত্রও তাদের ভাগ্যে জোটে না। জীবনের জোয়াল টেনে নিয়ে যায় তারা নিজ শক্তিতে ভর করে। বাবা ভাই স্বামী পুত্রের অবজ্ঞা তাদের হতোদ্যম করে না। ওরা জানে কি করে টিকে থাকতে হয়, সংসারের হাল ধরতে হয়। জগতের কোনো মাধ্যম তাদের ওপর আলো ফেলে না। নিজের আলোয় পথ চলে তারা। জীবন থেকে নেয়া শিক্ষায় শিক্ষিত, নিজেদের অজান্তেই আত্মশক্তিতে বলীয়ান প্রান্তিক নারীরা। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে সমাজের সুবিধাভোগী অগ্রবর্তী জনগোষ্ঠীর।
আমাদের সমাজ ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে দুর্ভাবনার বিষয় এই যে, নিবন্ধের শুরুতে উল্লিখিত আত্মস্বীকৃত সুন্দরী সমাজে একজন দু’জন নয়। দিনে দিনে বাড়ছে তাদের সংখ্যা। আর্থ–সামজিক নিক্তিতে সফলতার খাতায় নাম লেখানো নারীদের অনেকে একদিকে মেধার স্বাক্ষর রেখে বিভিন্ন দাপ্তরিক উঁচু পদ অলংকৃত করে নারীর ক্ষমতায়নের বিজ্ঞাপন করে চলেছেন, অন্যদিকে পোশাকে–আশাকে, আচার–আচরণে নিজেদেরকে পুরুষের চোখে সুন্দরী হিসেবে উপস্থাপনের জন্য নানাবিধ কসরত করে চলেছেন। দেশের সকল প্রতিষ্ঠানেই অনেক নারী এমন দ্বৈত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে চলেছেন, যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে তাঁরা আগামী দিনের নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে একজন শিক্ষিত নারীর নেতিবাচক আচরণ অনেক পরিবারকে তার কন্যাশিশুদেরকে শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে, আতংকিত করে, যা আমরা কখনও ভেবে দেখি না।
শুধু নারী কেন, একজন শিক্ষিত মানুষ তিনি নারী পুরুষ যা–ই হোন না কেন, তার নির্দিষ্ট কিছু আচরণবিধি মেনে চলা আবশ্যক। তাকে মনে রাখতে হবে তাকে দেখেই অন্যরা অনুপ্রাণিত হয়। প্রতিটি আচরণে তার দায়িত্বশীলতার ছাপ থাকা চাই। বিশেষ করে আমরা যারা রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে কৃষক শ্রমিকসহ সাধারণ কর্মজীবী জনগণের শ্রম ঘাম ও রক্তে ভেজা করের টাকায় উচ্চশিক্ষা লাভ করেছি বা করছি, সমাজের প্রতি তাদের দায়দায়িত্বটা অনেক বেশী। আমাদের মনে রাখতে হবে, উচ্চশিক্ষিত হয়ে উচ্চপদে সমাসীন হওয়ার মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে জীবনটাকে যাচ্ছেতাইভাবে উপভোগ করে যাওয়া কখনও শিক্ষার উদ্দেশ্য হতে পাওে না। আমরা শিক্ষিত নাগরিকরা প্রতিনিয়ত সে দায় দায়িত্বের কথা ভুলে যাই বলেই সমাজে থাবা বিস্তার লাভ করে আছে অস্থিরতা, সহিংসতা ও অরাজকতা। এর কি কোন শেষ নেই? আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে অবিবেচক, বেপরোয়া ও সহিংস হতে শেখায় না, বরং দূরদর্শী, সংযত ও সহনশীল হতে শেখায়। সমাজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, সবার উপরে আমাদের সন্তানদের জন্য সুস্থ্ ও বাসযোগ্য স্বদেশ গড়ে তুলতে শিক্ষিত নাগরিকদের দায়িত্বশীল আচরণের কোন বিকল্প নেই।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়