কক্সবাজারের মানুষ চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে রেল যোগাযোগের স্বপ্ন দেখছে শত বছরের বেশি সময় ধরে। ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে বৃটিশ সরকার বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে আরকানের (বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য) রেল যোগাযোগের গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রথম জরিপ কাজ চালায়। ১৮৯০ সাল থেকে শুরু হওয়া উক্ত জরিপ ১৮৯৩, ১৯০৩, ১৯১৭ ও ১৯১৯ সালে বিভিন্ন দফায় চলে। কিন্তু জরিপ চালানোর মধ্যেই এ কাজ সীমাবদ্ধ থেকে যায়।
বৃটিশরা ১৭৫৭ সালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা; ১৭৬০ সালে চট্টগ্রাম ও ১৮৬০ সালে আরকান দখল করে। পরে পাকিস্তান স্বাধীন হলে ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকার একটি জরিপ চালিয়ে এই প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় নিরূপণ করে। কিন্তু এ জরিপে কিছু অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হওয়ায় ১৯৫৭ সালে আবারও জরিপ কাজ চালানো হয়। পরে প্রকল্পটি আর এগোয়নি।
স্বাধীনতার পর রেল লাইন প্রকল্পটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৯৯৮ সালে জার্মান সরকারের আর্থিক সহায়তায় ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের দ্বিতীয় রুট হিসাবে বাস্তবায়নের প্রস্তাব আসলেও তা গৃহীত হয়নি। পরে ২০০০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র প্রদান করলে সেখানে চারটি কোম্পানি অংশগ্রহণ করে। পরের বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে রেল প্রকল্পটি আবারও মুখ থুবড়ে পড়ে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পটি নিয়ে আবারও নড়াচড়া শুরু হয়। ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত মিটারগেজ রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই বছরের জুলাই মাসে প্রকল্পটি (ডিপিপি) অনুমোদন পায়। সে সময় এর ব্যয় ধরা হয় ১৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এরপর ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার শহরতলীর বাস টার্মিনালের কাছে দোহাজারী–রামু–কক্সবাজার এবং রামু–ঘুমধুম মিটারগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু অর্থ সংস্থানের অভাবে প্রকল্পটি এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০১৭ সালে প্রকল্পটিতে অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে ১৮ হাজার ৩৫ কোটি টাকা করা হয়। এরপর ২০১৮ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
নির্মাণ কাজ শেষে সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গত ৫ নভেম্বর সকাল ৯টা ২০ মিনিটে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা জিআইবিআর এর একটি স্পেশাল ট্রেন ওইদিন সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে কক্সবাজার আইকনিক স্টেশন বিল্ডিংয়ে পৌঁছে। দোহাজারী–কক্সবাজার নতুন রেলপথের সবকিছু ঠিক আছে কিনা সেটি যাচাই করতেই গত রোববার ওই পরিদর্শন ট্রেন চালানো হয়।
চট্টগ্রাম–কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। দোহাজারী থেকে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, রামু হয়ে পাহাড় ও নদীপথ পেরিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যন্ত চলে এসেছে এই রেললাইন। এই পথে আছে ৯টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট এবং ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট।
দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে দেশের ৪৫তম জেলায় যুক্ত হচ্ছে রেল। এটি সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত মেগা প্রকল্প। এর মাধ্যমে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র–সৈকতের শহরে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ করা যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা আরও আশা করছেন, ট্রেন চালু হলে বদলে যাবে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প। এবছর রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে রেকর্ড সংখ্যক পর্যটক আসবে কক্সবাজারে। সেই সাথে বদলে যাবে কক্সবাজারের পাঁচ উপজেলা ও চট্টগ্রামের দুই উপজেলার মানুষের জীবনযাত্রা। বাড়বে ব্যবসা–বাণিজ্য। এছাড়া রেল লাইনকে কেন্দ্র করে পরিবহন, ব্যবসা–বাণিজ্যসহ বিভিন্ন খাতে হবে হাজারো মানুষের নতুন কর্মসংস্থান।