মোট শ্রমশক্তি বলতে অর্থনীতিতে নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল কর্মে নিয়োজিত পুরুষ এবং মহিলার মোট শ্রমশক্তির পরিমাণকে বুঝানো হয়। অবশ্য অর্থনীতির প্রয়োজনে উৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির পরিমাণ মোট শ্রমশক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে। অনুৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত শ্রম শক্তিকে অর্থনীতিতে বিবেচনা করা হয় না। অতএব মোট শ্রমশক্তি বলতে শুধুমাত্র উৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত মোট শ্রমশক্তিকে বুুঝানো হয়। আবার মোট জনসংখ্যার মধ্যে নারী ও পুরুষের অনুপাত সমান নয়। কোন কোন দেশে পুরুষের তুলনায় নারীর পরিমাণ অধিক। আবার কোন কোন দেশে নারীর তুলনায় পুরুষের পরিমাণ অধিক। যদিও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে নারী ও পুরুষের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে তবুও কিছু কিছু দেশে নারীর তুলনায় পুরুষের পরিমাণ কম। এতে প্রকৃতিগত ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। যেমন চীনের কোন কোন অঞ্চলে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এরূপ অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। শ্রমশক্তি বলতে মানুষের কর্মক্ষমতাকে বুঝানো হয়। যে সব দেশে নারী ও পুরুষের অনুপাত সমান নয়, সেসব দেশে নারী ও পুরুষের শ্রমশক্তি উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রায় সমভাবে ব্যবহার হতে দেখা যায়। যদিও অধিকাংশ মুসলিম দেশে পর্দানশীলতার কারণে নারী শ্রমশক্তিকে পরিপূর্ণভাবে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। যদি গবেষণার সুবিধার্থে প্রত্যেক দেশে নারী ও পুরুষের অনুপাতকে সমান হিসেবে ধরে নেয়া হয় তবে এক্ষেত্রে দেখা যায়, জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী শ্রমশক্তিকে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করা অসম্ভব। সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমাগত কিভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা করেন হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ক্লডিয়া গোলডিন। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে ২০২৩ সালে।
১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া শুরু হয়। সেই বছর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৫৫ বার অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। এ ৫৫ বার নোবেল পুরস্কারের মধ্যে এ পর্যন্ত তিনজন নারী অর্থনীতিবিদ অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁরা হলেন– এলিনর অষ্ট্রম, এস্থার দুফলো এবং ক্লডিয়া গোলডিন। ২০২৩ সালে ক্লডিয়া গোলডিন অর্থনীতিতে নোবেল দেয়া হয়েছে তাঁর গবেষণাকর্মী কাজের জন্য। ক্লডিয়া গোলডিনকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের পরিণতিতে কী ঘটেছে, সে বিষয়ে কিভাবে উন্নতি ঘটেছে, তা তিনি উদঘাটন করেন। বিগত ২০০ বছর সময়ে নারীর শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ ও তাঁদের আয় নিয়ে গবেষণা করেছেন গোলডিন।
বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এমন কি ক্ষেত্র বিশেষে উন্নত দেশগুলোতে নারী ও পুরুষের মোট শ্রমশক্তির অনুপাতের যেমন বৈষম্য রয়েছে তেমনি বৈষম্য রয়েছে মজুরি প্রাপ্তিতেও। যদিও সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে উন্নত দেশগুলোতে বিশেষ করে মজুরী বৈষম্য হ্রাস পাচ্ছে। আবার উৎপাদনশীল কাজে শ্রমশক্তি ব্যবহারের বৈষম্যও হ্রাস পাচ্ছে। তাই নোবেল কমিটি পুরস্কার ঘোষণার সময় বলেছে যে, অনেক উচ্চ আয়ের দেশে বিগত এক শতকে বেতন মজুরিভিত্তিক কাজে নারীর অংশগ্রহণ তিনগুণ হয়েছে। আধুনিক সময়ের ইতিহাসে এটি অন্যতম বৃহৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন। কিন্তু তা সত্বেও নারী পুরুষের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান রয়ে গেছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নারী পুরুষের ব্যবধানকে উন্মোচন করার জন্য ক্লডিয়া গোলডিন গত শতকের আশির দশকে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা শুরু করেন। তিনি অতি উচ্চ আয়ের দেশসমূহের ওপরও গবেষণা পরিচালনা করেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন। তিনি দেখতে পান যে, নারী–পুরুষের মধ্যে ব্যবধান সবসময় ছিল। যদিও একেক কালে তা ছিল একেক রকম। এই যে নারী–পুরুষের ব্যবধান এবং তার রূপ পরিবর্তন, ক্লডিয়া গোলডিনের গবেষণায় এর কারণ উন্মোচিত হয়েছে। ক্লডিয়া গোলডিনের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মূল বিষয় হচ্ছে, আগে এবং এখনো নারীর সিদ্ধান্ত মূলত তাঁর বিয়ে ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালনের নিরিখে নির্ধারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। তার গবেষণার পরিমণ্ডল মূলত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে হলেও তার অন্তর্দৃষ্টি কাল সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে যায়। বিগত ২০০ বছরের ধারাবাহিকতায় অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের ভূমিকা কী ছিল তার তথ্য–উপাত্ত বের করার জন্য তিনি আর্কাইভের সহায়তা গ্রহণ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো যে, একসময় সরকারি পরিসংখ্যানে শুধু পুরুষদের কাজের তথ্য উপাত্ত থাকত, নারীদের থাকত না। ফলে আর্কাইভে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে, রীতিমত গোয়েন্দার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে। উক্ত আর্কাইভ ঘেঁটে তাকে বের করতে হয়েছে, ২০০ শত বছর পূর্ব থেকে অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থায় নারীর ভূমিকা কী ছিল। এ তথ্য বের করতে গিয়ে তিনি প্রথাগত ধারণাকেও ভুল প্রমাণ করেছেন। প্রথাগতভাবে ধারণা করা হয় যে, সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ক্লডিয়া গোলডিন ২০০ বছরের তথ্য উপাত্ত নিয়ে গবেষণায় দেখেছেন, এই সময়ে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ শুধু বেড়েছে বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। বরং এ বিষয়ক রেখা চিত্র ইংরেজি ‘ইউ’ আকৃতির ন্যায়। অর্থাৎ সময়ের প্রেক্ষিতে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ প্রাথমিক অবস্থার ক্রমাগত কমতে থাকে। সর্বনিম্নস্তরে কিছু সময়ের জন্য স্থির থাকে। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ আবার বাড়তে থাকে। অর্থাৎ এই ইতিহাস সরলরৈখিক নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসে দেখা যায়, কৃষি নির্ভর অর্থনীতি থেকে শিল্প নির্ভর অর্থনীতিতে উত্তরণের সময় বিবাহিত নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমেছে। এরপর বিশ শতকের শুরু থেকে সেবা খাতে মোট শ্রমশক্তিতে নারী শ্রমশক্তি অন্তর্ভুক্ত হতে শুরু করে। অর্থাৎ মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। ক্লডিয়া গোলডিন এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তণ এবং পরিবার ও সমাজে নারীর দায়িত্ব কর্তব্যবিষয়ক সামাজিক রীতিনীতির পরিবর্তনের কারণে এমনটা হয়েছে। বিশ শতকে নারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। অধিকাংশ উচ্চ আয়ের দেশে নারীর শিক্ষার মান পুরুষের চেয়ে বেশি। মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি পাওয়ার আর একটি কারণ আছে বলে ক্লডিয়া উল্লেখ করেন। এসময়ে জন্ম বিরতিকরণ সামগ্রী সহজলভ্য হয়। নারী জন্ম দানের ক্ষেত্রে নিজস্ব মতামত তুলে ধরতে পারে। ফলে এটা নারীকে ক্যারিয়ার নিয়ে মতামত দেয়ার বা পরিকল্পনা করার সুযোগ দিয়েছে। অর্থাৎ জন্মদানের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দিয়েছে। অবশ্য এত পরিবর্তন সত্বেও এখনো কিছু পুরানো বিষয় রয়ে গিয়েছে বলে ক্লডিয়া মনে করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, দীর্ঘদিন ধরে নারী পুরুষের আয়ের ব্যবধান তেমন কমছে না। হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক মনে করেন, শিক্ষাবিষয়ক সিদ্ধান্ত সাধারণত কম বয়সে নেয়া হয়। এই কারণে নারী পুরুষের আয়ের ব্যবধান এখনও রয়ে গেছে। অবশ্য অনেকগুলো কারণের মধ্যে এ কারণটিকে আংশিক কারণ হিসেবে মনে করেন।
ক্লডিয়া গোলডিন এর গবেষণা থেকে একটি সত্য উঠে এসেছে যে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশে এখনো নারী ও পুরুষের মধ্যে আয় বৈষম্য বিদ্যমান। এ আয় বৈষম্য উন্নত দেশে কিছুটা কম থাকলেও অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এখনো নারী ও পুরুষের মধ্যে অধিক আয় বৈষম্য বিদ্যমান।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি