ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বেড়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। এতে বলা হয়, সদ্য সমাপ্ত অক্টোবর মাসে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে ১৯৭ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা গত চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রবাসীদের এখন প্রতি ডলারে সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও সমপরিমাণ প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে প্রবাসীরা বৈধ পথে পাঠানো প্রতি ডলারের জন্য ১১৫ টাকার বেশি পাচ্ছেন। কোনো কোনো ব্যাংক অবশ্য আরও বেশি দাম দেয়। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রবাসী আয়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, পুরো অক্টোবর মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। এর আগের তিন মাস ধারাবাহিকভাবে কমেছে। যেমন জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ, আগস্টে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ও সেপ্টেম্বরে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল। এর আগে জুনে আসে ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। জানা গেছে, অক্টোবরে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ১৭৫ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। এর বাইরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংক ১৫ কোটি ৪৪ লাখ, বিশেষায়িত একটি ব্যাংক ৫ কোটি ৮২ লাখ ও বিদেশি ব্যাংকগুলো ৬০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এনেছে।
দেশে ডলার–সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম বুধবার থেকে ৫০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। ফলে এখন থেকে এই দুই ক্ষেত্রে প্রতি ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সা হয়েছে। তবে প্রবাসী আয়ে ওই দামের সঙ্গে ৫ শতাংশ প্রণোদনা পাওয়া যায়। অন্যদিকে আমদানিকারকদের কাছে ১১১ টাকায় ডলার বিক্রি করছে ব্যাংকগুলো। সেই সঙ্গে আন্তব্যাংক লেনদেনে ডলারের সর্বোচ্চ দাম ১১৪ টাকা। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) যৌথ সভায় ডলারের নতুন দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়।
এদিকে ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ১১৪ টাকায় ডলার কিনে কীভাবে আমদানিকারকের কাছে ১১১ টাকায় বিক্রি করা হবে, সেটি বোধগম্য নয়। নথিপত্রে এক দাম, বাস্তবে আরেক। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে অনৈতিক পথের দিকে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি দেশের চাকা হলো অর্থনীতি। দেশ সচল থাকে এই অর্থের চাকার ওপর। আমাদের অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন বাধাবিপত্তি আছে। সে বিপত্তিগুলো অতিক্রম করতে হবে। প্রথমত, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য আমাদের বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। আবার দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রেমিট্যান্স। অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রবাসীদের পাঠানো এ অর্থ দেশের আর্থসামাজিক বিকাশে অন্যতম অনুঘটক হিসেবে বিবেচিত। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা নিয়ে আলোচনাটা তাই অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। যদিও দেশীয় শ্রমবাজারে শ্রমশক্তির চাহিদা ও জোগানের সমন্বয়হীনতার কারণে প্রবাসের শ্রমবাজার আমাদের শ্রমশক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে একদিকে যেমন প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স সামষ্টিক অর্থনীতির ভিতকে শক্তিশালী করছে, তাদের পাঠানো অর্থ দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুর পুষ্টি ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ প্রবাসী কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি রয়েছে সৌদি আরবে। সেখানে তাদের সংখ্যা প্রায় ১ দশমিক ২ মিলিয়ন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রেমিট্যান্সের কারণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও অনেক বেড়েছে। জীবন মান উন্নয়নের জন্য এবং আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অনেক লোক বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন এবং উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির ভিতকে মজবুত করে বৈদেশিক রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন তাদের অধিকাংশই অদক্ষ শ্রমিক। এসব বিদেশগামী শ্রমিককে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে বিদেশে পাঠানো হলে তারা আরো ভালো বেতনে চাকরি লাভের সুযোগ পাবেন। দেশও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে। বিদেশগামীদের অধিকাংশই অদক্ষ হওয়ার কারণে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকরা হাড়ভাঙ্গা খাটনি খেটেও ন্যায্য বেতন পাওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে নানা ধরনের সুযোগ–সুবিধা দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি করলে বাংলাদেশের অর্থনীতির কর্মকাণ্ডকে গতিশীলতার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে চাইছে, তাতে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।