ড. মঈনুল ইসলামের কলাম

ভারতের ইতিবাচক ও নেতিবাচক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের শিক্ষণীয়

| বৃহস্পতিবার , ৯ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারতকে একটি আংশিকভাবে সফল দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যদিও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের তুলনায় ভারতের উন্নয়ন উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে রয়েছে। ১৯৪৯ সালে যখন চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয় তখন চীনের জনগণের জীবনযাত্রার মান ভারতের মতই ছিল, কিন্তু পরের ৯ বছরে চীন অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারতকে ছাড়িয়ে যায়। ১৯৫৮ সালে চীন যখন ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ বাস্তবায়ন শুরু করে তখন ঐ ভুল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলের জেরে তিন/চার বছর ধরে চীনে বেশ কয়েকটি বড় বড় দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ায় কয়েক কোটি মানুষ ওখানে মৃত্যুর কবলে পতিত হয়। ঐ পর্যায়ে ভারতে ব্যাপক খাদ্যাভাব সমস্যা থাকলেও কোন উল্লেখযোগ্য দুর্ভিক্ষ ভারতে হয়নি। ফলে, ঐ পর্যায়ে ভারতীয়রা চীনের জনগণের চাইতে খাদ্য নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের বিবেচনায় অনেকখানি অবাধ ও সুষ্ঠু জীবন যাপনের পরিবেশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রফেসর অমর্ত্য সেন দারিদ্র্য সম্পর্কিত তাঁর বিশ্বখ্যাত বই ডেভেলাপমেন্ট এজ ফ্রিডমএ দাবি করেছেন, কোন দেশে অবাধ গণতন্ত্র ও স্বাধীন গণমাধ্যম চালু থাকলে ঐ দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ৭৪ বছর পরও চীনে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে জনগণ এখনো সত্যিকার স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি, দেশটি এখনো একদলীয় শাসনের ‘ভয়ের রাজত্বই’ রয়ে গেছে। জনসংখ্যার দিক্‌ থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত থেকে বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় হলো, কোন অজুহাতেই প্রকৃত গণতন্ত্রকে বিঘ্নিত করা যাবে না, লাইনচ্যুত করা যাবে না। গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কারণেই বাংলাদেশকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে এক নদী রক্ত ও দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কবল থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হয়েছিল। আবার, পনেরো বছরের সামরিক স্বৈরশাসনকে উৎখাত করার জন্য ১৯৯০ সালে একটি গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করতে হয়েছে বাংলাদেশের জনগণকে। অতএব, এদেশের জনগণের সর্বাপেক্ষা বড় আমানত হলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার নামে কোন শাসক যদি এই অধিকার ছিনিয়ে নিতে চায় তাকে পরম শত্রু বিবেচনায় রুখে দাঁড়ানো ও যে কোন মূল্যে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা জনগণের প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতেই হবে।

বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকের শেষদিকে এসে ভারত খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে। ২০২৩ সালের ভারত বিশ্বের শীর্ষ চাল রফতানিকারকে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৮ সালে চীনের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরুর পর্যায়ে চীন ও ভারতের অবস্থান অর্থনৈতিক দিক্‌ থেকে অনেকখানি কাছাকাছি থাকলেও গত ৪৫ বছরে চীন এত দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সফল হয়েছে যে এখন চীনের মাথাপিছু জিডিপি ভারতের মাথাপিছু জিডিপি’র চার গুণেরও বেশি হয়ে গেছে। ২০১৪ সালে ক্রয়ক্ষমতা সাম্যের (purchasing power parity) ভিত্তিতে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। ২০২৮ সালে তারা নমিনাল জিডিপি’র বিবেচনায়ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির তক্‌মা অর্জন করার পথে অগ্রসর হচ্ছে। চীনের দক্ষিণাঞ্চলের জনগণের জীবনযাত্রার মান এখন উন্নত দেশগুলোর সমপর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। ১৯৯১ সালে ভারতেও ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ফলে, গত ৩২ বছরে ভারতের অর্থনীতিতেও প্রশংসনীয় গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৩ সালে ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে, এবং ২০৩০ সাল নাগাদ চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেছনে ভারত বিশ্বের তৃতীয়বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও বিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক গতিশীলতা সৃষ্টি হওয়ায় ২০২৩ সালে এসে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুতবর্ধনশীল পাঁচটি দেশের একটিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালে যে দেশটিকে ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল সে দেশকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল ২০২০ সালে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ ঘোষণা করেছেন। আইএমএফ ঘোষণা করেছে, ২০২১ সালে মাথাপিছু জিডিপি’র পরিমাপে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। গড় আয়ু, শিশু মৃত্যুর হার, জেন্ডার সমতা এবং বাড়ির বাইরে কর্মরত নারীর অনুপাতের মত অনেক সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চাইতে অগ্রগামী। অবশ্য, এসব তথ্য নিয়ে আত্মতৃপ্তির অবকাশ নেই।

কারণ, স্বীকার করতে হবে যে জীবনযাত্রার মানের বিচারে বাংলাদেশের জনগণ এখনো ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যের জনগণের কাতারে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফলকে প্রধানত সমাজের উচ্চবিত্ত গোষ্ঠীর করায়ত্ত করে ফেলেছে, যার ফলে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত জনগণ আজো অর্থনৈতিক সচ্ছলতার সন্ধান পায়নি। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান ভারতে বাংলাদেশের চাইতে ভাল। এসব মৌলপ্রয়োজনীয় (বেসিক নীডস) জিনিসপত্র ও সেবার দাম সাধারণভাবে ভারতে বাংলাদেশের চাইতে কম, ভারতে মূল্যস্ফীতির হারও বাংলাদেশের অর্ধেকের কম। বিশেষত, ভারতে সাধারণ জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান বাংলাদেশের চাইতে ভাল হলেও সেগুলো কম ব্যয়বহুল ও সহজলভ্য। দামে সুলভ হওয়া সত্ত্বেও মানের দিক্‌ থেকে ভারতের স্বাস্থ্যসেবা ইতোমধ্যেই বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে পৌঁছে গেছে। কেরালা, কর্নাটক ও তামিলনাড়ুর মত কয়েকটি ভারতীয় রাজ্য রাজ্যের সকল জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা এবং সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। সব ধরনের পরিবহন ব্যয়ও ভারতে অনেক কম। এমনকি, জমির দাম, বাড়ির দাম, বাড়ির নির্মাণ ব্যয় ও বাড়িভাড়া ভারতে বাংলাদেশের চাইতে অনেক কম। সেজন্যই ক্রয়ক্ষমতা সাম্যের ভিত্তিতে এখনো ভারতের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই বাংলাদেশের জনগণের চাইতে বেশি। বিশ্ব ব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ইন্ডিকেটর্স মোতাবেক ২০২২ সালে ভারতের মাথাপিছু জিএনআই ছিল ৬,৯৫৪.২ পিপিপি ডলার আর বাংলাদেশে ৬,৫১১.১ পিপিপি ডলার। মোদ্দা কথায় বলা চলে, ভারতের সাধারণ জনগণের জীবন বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের জীবনের তুলনায় বেশি ব্যয়সাশ্রয়ী রয়ে গেছে। অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা এবং পশ্চিম ভারতীয় রাজ্য হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই বাংলাদেশের চাইতে অনেক বেশি। অবশ্য, উত্তর ভারতের বিহার, ছত্রিশগড়, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ এবং উত্তরপূর্ব ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলোর জনগণের চাইতে বাংলাদেশের জনগণ অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করছে বলা যায়। এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চাইতেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক সূচকে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। (ভারতে উত্তরের ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মাথাপিছু আয়বৈষম্য ক্রমবর্ধমান, বাংলাদেশেও উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণপশ্চিম বাংলাদেশের জেলাগুলোর জনগণ ঢাকা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগ ও সিলেট বিভাগের তুলনায় অপেক্ষাকৃতভাবে অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার শিকার)

ভারতে তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্র সুদৃঢ় শিকড় গেড়ে বসেছে, যেজন্য ওখানে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর ও শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে গেছে। বিশেষত, কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কর্নাটক ও মহারাষ্ট্রে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা খুবই প্রতিনিধিত্বশীল ও গণতান্ত্রিক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। ‘কেরালা মডেল’ বিশ্বে ‘জনগণের অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের’ আদর্শ ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা, বৈষম্যহীন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, বেকার ভাতা, রাজনৈতিক পরমতসহিষ্ণুতা ও জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ নির্দ্বিধায় কেরালাকে অনুসরণ করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের ‘অপারেশন বর্গা’ বাংলাদেশের জন্য কৃষি সংস্কারের আদর্শ মডেল হওয়ার দাবি রাখে। ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার এবং তা ক্রমবর্ধমান, যেজন্য ওখানে কোন ডলার সংকট নেই। ভারতে অভিবাসীদের রেমিট্যান্স আসে বিশ্বের সব দেশের চেয়ে বেশি, প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। ওখানেও হুন্ডি ব্যবস্থা (যেটাকে তারা ‘হাওয়ালা’ বলে) ক্রিয়াশীল, কিন্তু হাওয়ালা ব্যবসা ভারত থেকে বিদেশে পুঁজিপাচারে অপব্যবহৃত হয় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারে কিভাবে কঠোরহাতে পুঁজিপাচারকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যায়। বর্তমানে এই হুন্ডি ব্যবসার দৌরাত্ম্যে বাংলাদেশের ফর্মাল চ্যানেলে পাঠানো রেমিট্যান্স ক্রমেই কমে যাচ্ছে, কারণ হুন্ডি ব্যবস্থায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো অধিকাংশ বৈদেশিক মুদ্রা পুঁজিপাচারকারীরা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে যাচ্ছে, ডলার সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে, এবং ডলারের বাজারে একাধিক দাম চালু রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও ভারত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি সফল। কিভাবে এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে সেটা ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা শিখে নিতে পারে।

ভারতের নেতিবাচক বিষয়গুলোর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হবে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও ক্রমবর্ধমান সংঘাতের বিষয়টিকে। বিশেষত, নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি শাসনামলে কট্টর হিন্দুত্ববাদের জোয়ার ভারতকে মধ্যযুগের অন্ধকারে নিমজ্জিত করে ফেলেছে। পাঠকদের হয়তো মনে আছে, ২০১৪ সালে যখন নরেন্দ্র মোদী ভারতের নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তখন নোবেল পুরস্কারবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন কট্টর সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে, কিন্তু ২০১৪১৯ সালের পাঁচ বছরের মেয়াদে তাঁর জনপ্রিয়তায় মোটেও ভাটার টান পরিলক্ষিত হয়নি। বরং, ২০১৯ সালের নির্বাচনে মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি আরো বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পুনর্নির্বাচিত হয়েছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বিজেপি তাদের কট্টর হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাকে কোন রাখঢাক ছাড়াই সামনে নিয়ে এসেছে। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মোদী সরকার একের পর এক এই হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়িত করে চলেছে, যার মধ্যে ভারতীয় সংবিধানে প্রদত্ত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার বিলোপ, ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনশীপ (এনআরসি) আইন পাশ এবং সিটিজেনশীপ এমেন্ডমেন্ট এক্ট (সিএএ) পাশ সারা ভারতে এবং বিশ্বেও প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সিটিজেনশীপ এমেন্ডমেন্ট এক্টে যেভাবে মুসলিমদেরকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশকারী অন্য সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে ভারতীয় নাগরিক হওয়ার বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছে তা যে চরম বৈষম্যমূলক ও অগ্রহণযোগ্য সাম্প্রদায়িকতা সেটা খোদ জাতিসংঘকেও ঘোষণা করতে হয়েছে। কিন্তু, মোদী পুরোপুরি নির্বিকার। কারণ মোদী বুঝতে পেরেছেন, হিন্দুত্ববাদী চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতির আফিম এখন ভারতীয়দের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। অতএব, আগামী কয়েকটি নির্বাচনেও বিজেপি’র বিজয়ের সম্ভাবনা এই আফিমের মৌতাতে বাড়বে বই কমবে না। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ২০১৪ সালের পর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ভারতের কুড়ি কোটি মুসলিম জনগোষ্ঠী এখন আক্ষরিকভাবেই মানবেতর পর্যায়ে জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে, তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকও বলা যাবে না এখন। ভারতের বিভিন্ন স্থানে এখনো হিন্দুমুসলিম দাঙ্গা প্রাণঘাতী সমস্যা হিসেবে বহাল রয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনগণের একাংশও এহেন ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ ধারণ করে রয়েছে, কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কঠোরভাবে এসব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠিগুলোকে দমনে তৎপর থাকায় তারা এদেশে মাথা তুলে সমাজকে দংশন করতে পারছে না। সেজন্য বলা চলে, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজন অনেক কমক্ষতিকর পর্যায়ে বিরাজমান। ভারত এক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিতে পারে কিভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখা যায়। বাংলাদেশে কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা ক্রিয়াশীল রয়েছে, কিন্তু তাদেরকে এদেশের বর্তমান সরকার কঠোরভাবে দমন করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চলেছে। ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী হামলা আর ঘটাতে পারেনি কথিত ইসলামী জঙ্গিরা।

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্নের ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সক্ষমতার স্মারক
পরবর্তী নিবন্ধঅবরোধে সহিংসতায় আহতদের চিকিৎসা সেবায় রেড ক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ