১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নেয়া হয়, সে গানের শুরুতেই বলা হয়েছে– ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর বিদেশি সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশে কোনোরকম খনিজদ্রব্য সোনা–দানা, হীরা–মুক্তা, তেল সম্পদ বলতে কিছুই নেই, তা সত্ত্বেও বাংলাদেশটিকে আপনি বার বার সোনার বাংলা বলে চিহ্নিত করছেন কেন? সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন– “আমার বাংলার মাটি আছে, আমার বাংলার মানুষ আছে। আমি বাংলার মাটি এবং মানুষকেই সোনা বলে মনে করি। দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। খনিজ সম্পদের চেয়েও বড় সম্পদ। এই মানবসম্পদই একদিন বাংলাদেশকে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যাবে।” বাঙালি জাতির ভাগ্য উন্নয়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি যে সম্ভব নয়, তা অনুধাবন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় “দৌলতপুর কলেজে ছাত্র সভা” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১ ডিসেম্বর অধ্যক্ষদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই ছাত্র সভায় শিক্ষা সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “শিক্ষাদীক্ষাই হলো মানব সভ্যতার মাপকাঠি, অথচ আমাদের দেশের অগণিত জনসাধারণকে অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখে কোন মুখে আমরা বিশ্ব দরবারে নিজদিগকে সভ্য জাতি বলিয়া গৌরব করিব? আজ দেখতে পারছেন আমাদের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ধ্বংস হতে বসেছে। শিক্ষকদের বেতন না বাড়ালে শিক্ষা সমস্যার সমাধান অসম্ভব। শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করা দরকার।”
বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। দলের ম্যানিফেস্টোতে শিক্ষানীতি সমপর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল – ‘রাষ্ট্রের প্রত্যেকের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে। শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্রের হাতে থাকিবে এবং প্রত্যেক নারী–পুরুষের পক্ষে শিক্ষা বাধ্যতামূলক করিতে হইবে। দেশের সর্বত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিয়া শিক্ষা সহজলভ্য করিতে হইবে। উচ্চতর শিক্ষা – বিশেষ করিয়া কারিগরি শিক্ষার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্র খুলিতে হইবে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে সরকারি বৃত্তির সাহায্যে উচ্চতর শিক্ষা উৎসাহিত করিতে হইবে। মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করিতে হইবে।’
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা ভিত্তিক নির্বাচনী ইশতেহার প্রদান করে। যুক্তফ্রন্টে প্রধান শরিক দল ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ; অন্য তিনটি দল ছিল – কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজাম–এ–ইসলাম এবং বামপন্থি গণতন্ত্রী দল। যুক্তফ্রন্টের ম্যানিফেস্টো ২১ দফায় শিক্ষার প্রসঙ্গে ৯ দফায় ছিল, ‘দেশের সর্বত্র একযোগে প্রাথমিক অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করা হবে এবং শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে। ১০ দফায় ছিল, শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করিয়া শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকরী করিয়া সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহের মধ্যে ভেদাভেদ উঠাইয়া দিয়া একই পর্যায়ভুক্ত করিয়া সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি সাহায্যপুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হইবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল কানুন বাতিল/রহিত করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিয়া উচ্চশিক্ষাকে সস্তা ও সহজলভ্য করা হইবে এবং ছাত্রাবাসের অল্প ব্যয়–সাধ্য ও সুবিধাজনক বন্দোবস্ত করা হইবে। উক্ত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি, সমবায় ও পল্লী উনয়ন বিভাগের দাযিত্ব পান। ফলস্বরূপ, ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। জাতির পিতা বলেছিলেন, “দেশের প্রাপ্তব্য সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার ও ইহাকে জনগণের কাজে লাগানই হইতেছে দেশকে শিল্পায়িতকরণের উদ্দেশ্য কর্মসংস্থানের সুযোগ–সুবিধার সম্প্রসারণ ও ইহাকে সর্বাবস্থায় বহুমুখীকরণই ইহার যুক্তিসঙ্গত ও অপরিহার্য পরিপূরক।”
১৯৭০–এর নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে প্রতিফলিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা। ১৯৭০ এর ২৮ অক্টোবর পাকিস্তান টেলিভিশন সার্ভিস ও রেডিও পাকিস্তান আয়োজিত ‘রাজনৈতিক সম্প্রচার’ শীর্ষক বক্তৃতামালা অনুষ্ঠানে তিনি শিক্ষা সম্পর্কে বলেছিলেন – ‘সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর হতে পারে না। ১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পরিসংখ্যান একটা ভয়াবহ সত্য। আমাদের জনসংখ্যার শতকরা ৮০ জন অক্ষরজ্ঞানহীন। প্রতিবছর ১০ লাখের অধিক নিরক্ষর লোক বাড়ছে। জাতির অর্ধেকেরও বেশি শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। শতকরা মাত্র ১৮ জন বালক ও ৬ জন বালিকা প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করছে। জাতীয় উৎপাদনের শতকরা কমপক্ষে ৪ ভাগ সম্পদ শিক্ষা খাতে ব্যয় হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। কলেজ ও স্কুল শিক্ষকদের বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে। পাঁচ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটি ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সকল শ্রেণির জন্য খোলা রাখতে হবে। দ্রুত মেডিক্যাল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সহ নয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দারিদ্র্য যাতে উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবী ছাত্রদের অভিশাপ না হয়ে দাঁড়ায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ও উর্দু যাতে ইংরেজির স্থান দখল করতে পারে– সে ব্যাপারে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা করতে হবে। আঞ্চলিক ভাষার বিকাশ ও উন্নয়নের ব্যাপারে উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে।’
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেষ্টোতে শিক্ষা সম্পর্কিত যে গুরুত্বপূণ বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করা হয় তা হলো: ১। আমাদের সমাজের মৌলিক প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের সর্বাধিক উন্নতি সম্ভব করে তোলাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। ২। শিক্ষায় বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হবে। মোট দেশজ উৎপাদনের চার ভাগ এই খাতে নিয়োজিত করতে হবে। ৩। এই অধিক বরাদ্দ থেকে গৃহাদি নির্মাণ বাবদ অপেক্ষাকৃত কম খরচ করে শিক্ষকদের বেতন–স্কেল বাড়ানোর জন্য বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। ৪। নিরক্ষতা দূরীকরণে নতুন কৌশল হিসেবে ‘জাতীয় সার্ভিস’ প্রোগ্রামে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানোর কথা বলা হয়েছিল। ৫। প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক। ৬। মাধ্যমিক শিক্ষা জনসাধারণের নাগালের মধ্যে আনা। ৭। উৎপাদনমুখী শিক্ষার লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষার জন্য বিশেষ নির্দেশনা – ‘সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে সমাজের ছাঁচে ঢালাই করা হবে এবং এ ধরনের প্রয়োজন সম্পর্কে সুষ্ঠু জরিপের পরই কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে।’ ৮। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একাডেমিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিশেষ পরিকল্পনা। প্রথমবারের মতো উল্লেখ করা হলো যে, শিক্ষাবিদদের মধ্য থেকে চ্যান্সেলর নিয়োগ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে এবং ৯। ‘শিক্ষকতা পেশা’ শিরোনামে একটি অনুচ্ছেদ ছিল, যাতে বলা হয়েছিল, ‘আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যাতে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট হন, সেই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সব রকম চেষ্টা করা হবে। এজন্য কেবল তাদের বেতনের স্কেল বৃদ্ধি ও বৈষয়িক সুবিধা দিলেই চলবে না। সঙ্গে সঙ্গে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি এবং সম্মান দিতে হবে।’
স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুগপৎভাবে শিক্ষার সকল স্তরে, সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের কার্যক্রম গ্রহণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং সীমিত সম্পদের দেশে শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা ছিল অত্যন্ত দুঃসাহসিক এবং চ্যলেঞ্জিং। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা করতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দেশের শতকরা ষাট ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি শিক্ষা বিভাগের এক ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১–এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাত্র বেতন মওকুফ করে দেন। বিধ্বস্ত সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠনের জন্য ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে একান্ন কোটি টাকা বরাদ্দ করেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা ঘোষণা দেওয়া হয়। তাছাড়া পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান ও ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে চল্লিশ ভাগ কম দামে বই সরবরাহের ঘোষণাও করা হয়েছিল। নিরক্ষরতা দূরীকরণে ১৯৭২ সালেই সরকার গণশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৭২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেন। তিনি ৯০০ কলেজ ভবন ও ৪০০ হাই স্কুল ভবন পুনঃনির্মাণ করেন। বঙ্গবন্ধু সরকার দেশে ১১,০০০ নতুন প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করেন। বিশৃঙ্খল শিক্ষাব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য এবং শিক্ষাকে বেগবান করার জন্য নানামূখী কর্মকৌশল গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু।
শিক্ষার ওপর বঙ্গবন্ধু যে অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন তার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে। ওই বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে তিন কোটি বাহাত্তর লাখ টাকা বেশি বরাদ্দ করা হয়েছিল। গণশিক্ষা বিস্তারে তথা নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বরাদ্দ করেছিলেন আড়াই কোটি টাকা। তাছাড়া অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি, যা ছিল নারী শিক্ষা অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের শিক্ষাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে বিনামূল্যে বই, খাতা, পেনসিল, দুধ, ছাতু ও বিস্কুট বিতরণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষা উন্নয়নের জন্য সাধারণ মানুষের সন্তানেরা যেন শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে, সেজন্য ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের মধ্যে ৩৬,১১৫ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। এর ফলে ১,৫৫,০২৩ জন শিক্ষকের চাকরি সরকারি হয় এবং ১৯৭৩ সালের জুলাই মাস থেকে তা বাস্তবায়ন করা হয়। যেখানে সরকারি কোষাগারে তেমন কোনো অর্থ ছিল না, বিদেশি সাহায্য ছিল অপর্যাপ্ত, সেখানে এই জাতীয়করণের পদক্ষেপটি ছিল সত্যিই দুঃসাহসিক এবং তিনি তা বেশ সফলতার সঙ্গেই সম্পন্ন করেছিলেন। শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করে। শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হবে। ভারত বর্ষে প্রাচীন কাল থেকেই ইসলামি ভাবধারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু ছিল। সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আরও কার্যকরী করতে বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা এডুকেশন অর্ডিন্যান্স– ১৯৭২ জাতীয় সংসদে পাস করেছিলেন। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে গবেষণার উপকরণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে National Archives of Bangladesh প্রতিষ্ঠা করেন।
ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা–প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত আটটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হলেও সেগুলো ছিল পাকিস্তান সরকারের তল্পীবাহক; ফলে সে সব প্রতিবেদনে দেখতে পাওয়া যায় জনমানুষের সমাজ–সংস্কৃতি আর মৌলচেতনা বিরোধী চিন্তাচেতনা।
১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের পূর্বে শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট সমপর্কিত এক আলোচনায় বঙ্গবন্ধু সুসপষ্টভাবে বলেন, “আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যাতে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট হন সেই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সব রকম চেষ্টা করা হবে। এজন্য কেবল তাদের বেতন স্কেল বৃদ্ধি ও বৈষয়িক সুবিধা দিলে চলবে না, সঙ্গে সঙ্গে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি এবং শিক্ষকদের ন্যায্য মর্যাদা এবং সম্মানও দিতে হবে।”
লেখক : উপাচার্য, রাঙ্গামাটি বিঞ্জান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।